করোনার প্রাদুর্ভাব কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে মাছ রফতানি খাত। টানা কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর আবারও শুরু হয়েছে মাছ রফতানি।
Advertisement
জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে দক্ষিণাঞ্চল খুলনা বিভাগ থেকে মাছ রফতানি হয়েছে ৭৬২.৪৬ কোটি টাকার। রফতানি হওয়া মাছের মধ্যে বাগদা, গলদা ও হরিণা চিংড়ি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া দেশীয় প্রজাতির সামান্য কিছু মাছও রফতানি হয়েছে।
সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর বড় মাছের বাজার। অর্ধশত প্রজাতির মিষ্টি ও লোনা পানির মাছের পর্যাপ্ত সরবরাহ এ বাজারে। প্রতিদিন এ বাজার থেকে মাছ বেচা-বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১২-১৫ টন।ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিষ্টি পানির মাছের থেকে লোনা পানির মাছের স্বাদ বেশি হওয়ায় খুচরা ক্রেতাদের কাছে এ মাছের চাহিদা বেশি।
সাতক্ষীরা বড় বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আমির হোসেন জানান, চিংড়ি মাছ রফতানিতে এগিয়ে থাকলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে ক্রেতাদের মাঝে চাহিদা বেশি দেশীয় সুস্বাদু মাছের। খুচরা ক্রেতারা সাধারণত বেশি ক্রয় করেন ভেটকি, ভাঙান, পারশে, ট্যাংরা, দাতিনা, ভোলা ও ছোট হরিণা, চাকা, চামনি চিংড়ির। এছাড়া বাজারে রুই, কাতল, সিলভার, তেলাপিয়া, পাঙাসসহ অর্ধশত প্রজাতির মাছের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে।
Advertisement
সাতক্ষীরা মৎস্য অধিদপ্তরের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, জেলায় মোট বাগদা চিংড়ির চাষী রয়েছে ৫২৩৪৫ জন। এসব চাষীর ঘের রয়েছে ৫৪৯৩৫টি। চাষীরা বাগদার চাষ করেছেন ৬৬ হাজার ৮৬২ হেক্টর জমিতে।
এ বছর বাগদা চিংড়ির উৎপাদন হয়েছে ২১ হাজার ৪৪১ মেট্রিক টন। তাছাড়া গলদা চিংড়ির চাষী রয়েছে ৯৮৬৭ জন। ঘেরের সংখ্যা ১১৬৬২টি। এসব চাষী ৯৩৭৮ হেক্টর জমিতে গলদার চাষ করেছেন। উৎপাদন হয়েছে ৬৫৪২.৫ মেট্রিক চন। এসব মাছের ঘেরে হরিণা চিংড়ির উৎপাদন হয়েছে ৩৪১০ মেট্রিকটন। এ ছাড়া এসব মাছের ঘেরে অন্যান্য বিভিন্ন প্রজাতির মাছের উৎপাদন হয়েছে ৩১৩৯৩.৫ মেট্রিক টন।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, মাছের ঘেরগুলোতে মাছের উৎপাদন বেড়েছে। তাছাড়া করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবের শুরুতে টানা কয়েকমাস রফতানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ঘের ব্যবসায়ীরা মাছ ধরতে পারেনি। এবার মাছের ঘেরে পানির পরিমাণ বেশি থাকায় মাছের আকারও বড় হয়েছে। করোনায় রফতানি বন্ধের কারণে মাছে জেলায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২০০ কোটি টাকা। রফতানি শুরু হয়েছে আবার উৎপাদনও বেড়েছে ফলে চাষীরা করোনাকালীন ক্ষতি পুষিতে নিতে পারবেন।
তিনি বলেন, মূলত বিদেশে চিংড়ি মাছ বেশি রফতানি হয়। আর দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু মাছগুলো চলে যায় দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে। চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর ও ঢাকায় দক্ষিণাঞ্চলের মাছের চাহিদা অনেক বেশি। রফতানিতে চিংড়ি মাছ এগিয়ে থাকলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে দেশি মাছের চাহিদা বেশি রয়েছে। কি পরিমাণ মাছ বিদেশে রফতানি হয়েছে সেটির পরিসংখ্যান করেন খুলনা কোয়ালিটি কন্ট্রোল কার্যালয়।
Advertisement
খুলনা কোয়ালিটি কন্ট্রোল কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চলতি অর্থ বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে খুলনা বিভাগ থেকে ৯৯২৮ মেট্রিক টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ রফতানি হয়েছে। রফতানি হওয়া মাছের মধ্যে গলদা, বাগদা ও হরিণা চিংড়ি উল্লেখযোগ্য।
গলদা চিংড়ি রফতানি হয়েছে ৮১০ মেট্রিক টন, বাগদা ৬৫২০ মেট্রিক টন, হরিণা চিংড়ি ২৪২ মেট্রিক টন, ৭২ মেট্রিক টন বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় সাদা মাছ, কাকড়া ১২৫ মেট্রিক টন। বাকিগুলো মাছের আশ ও চিংড়ির খোসা রফতানি হয়েছে।
জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ৭৬২.৪৬ কোটি টাকার মাছ রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে গলদা রফতানি হয়েছে এক কোটি ২৯ লাখ ৯৬ হাজার ২৩৫ ডলার, বাগদা ৬ কোটি ১৪ লাখ ৪১ হাজার ১৬ ডলার, হরিণা চিংড়ি ১৯ লাখ ৫১ হাজার ১২৮ ডলার ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ রফতানি হয়েছে ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪১ ডলার।
সাতক্ষীরা সদরের বিনেরপোতা বাজারে প্রতিদিন দেড় কোটি টাকার মাছ ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে বলে জানান আড়ৎ ব্যবসায়ীদের নেতা আসাদুজ্জামান।
ওই বাজারের সাতক্ষীরা ফিস এর স্বত্ত্বাধিকারী আলহাজ নূরালী মোড়ল জানান, বিনেরপোতা মাছের আড়ৎ থেকে প্রতিদিন ৬-৭ ট্রাক মাছ রফতানি হচ্ছে। এসব মাছ চলে যাচ্ছে সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর ও ঢাকার বাজারগুলোতে।
সাতক্ষীরা সদরের মাছের ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন ৩-৪ ট্রাক মাছ রফতানি করছি। আমি চট্টগ্রামে মাছ পৌঁছে দেই। প্রতি ট্রাকে ১৫-১৬ টন মাছ রফতানি হয়। এক ট্রাক মাছের মূল্য কমপক্ষে ৫-৬ লাখ টাকা। করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবে সবকিছু বন্ধ থাকায় টানা কয়েকমাস রফতানি কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এখন পুনরায় রফতানি কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়েছে।
খুলনা কোয়ালিটি কন্ট্রোল কার্যালয়ের মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা এটিএম তৌফিক মাহমুদ বলেন, শতকরা ৮০ ভাগ বাগদা চিংড়ি রফতানি হয় ইউরোপের ২৭টি দেশে। ২০ ভাগ যায় আমেরিকা, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে। এছাড়া মোট রফতানির শতকরা দুই ভাগ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ রফতানি হয় অন্যান্য দেশগুলোতে।
তিনি বলেন, করোনা দুর্যোগ কাটিয়ে জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বিদেশে মাছ রফতানি হয়েছে ৭৬২.৪৬ কোটি টাকার। অক্টোবর মাসের হিসাব কার্যক্রম এখনও শেষ হয়নি। করোনার প্রার্দুভাব কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে মাছ রফতানি খাত। বর্তমানে কুচিয়া ও কাকড়া রফতানি বাজারটি হারিয়েছি আমরা। কেননা, কুচিয়া ও কাকড়া রফতানি বড় বাজার চীন। করোনার কারণে চীনে এখনও রফতানি শুরু হয়নি।
এমএএস/পিআর