সালমান ইসলাম
Advertisement
এখানে বসে রুইলুই পাড়া উপভােগ করার সেরা জায়গা। চারদিকে সবুজ, উঁচু-নিচু পাহাড়, দূরে কংলাক পাড়া- সবই চোখের সামনে। কিছুক্ষণ পরেই সূর্য হেলে পড়ল পশ্চিম আকাশে। রক্তিম একটা অবয়ব ধারণ করল রুইলুই পাড়াজুড়ে। সূর্যকে বিদায় জানিয়ে কণ্ঠে গান বেজে উঠল, ‘ওই দূর পাহাড়ে, লােকালয় ছেড়ে দূরে, মন কেড়ে ছিল এক দুরন্ত মেয়ে, সেই কবে।’ কিছুক্ষণ গল্প-আড্ডা-গান শেষে চলে গেলাম রেস্টুরেন্টে।
রাতের খাবারে ছিল ব্যাম্বু চিকেন। যা ওখানকার বিশেষ খাবারের মধ্যে অন্যতম। এখানেও সেই বাঁশের সুনিপুণ ব্যবহার। আগুনের অনিয়ন্ত্রিত তাপে বাঁশের ভেতরেই সেদ্ধ হয় মুরগির মাংস। আর সাথে পড়াটা। যা এখনো মুখে লেগে আছে।
খাওয়া শেষে সবাই রাতের সৌন্দর্য দেখতে এগিয়ে গেলাম আবার হেলিপ্যাডের কাছাকাছি একটি জায়গায়। যেখানে বেঞ্চের ধারেই খাড়া পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত ছিল পুরো উপত্যকা। হঠাৎ দেখি আকাশে হালকা মেঘ। রুমে ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ পর জানালা দিয়ে দেখি কুয়াশা ভেসে আসছে। বাইরে গিয়ে পাশের মানুষ দেখা যাচ্ছে না। এর কিছু পরে দেখি বৃষ্টি। পরদিন ভোর ৫টায় উঠতে হবে। তাই আর বেশি রাত পর্যন্ত রাতের মুগ্ধতা নেওয়ার সুযোগ ছিল না। ঘুমিয়ে যেতে হয়েছিল।
Advertisement
পরদিন ভোরে যখন ঘুম ভাঙলো জানালা দিয়ে চোখ গেলো বাইরে। রাতের অন্ধকার তখন ঘুচে যেতে শুরু করেছে। যেভাবে ড্রয়িং করার সময় পেন্সিলে এঁকে এরপর রং করা শুরু হয়; তেমনি মনে হচ্ছে এই ভোরবেলা চারপাশটা কেউ রং করা শুরু করল। মিষ্টি বাতাসের সঙ্গে খালি চোখে মেঘের ভেলা দেখে আর বিছানায় থাকতে পারিনি, উঠে যাই বারান্দায়। সে কী মেঘের খেলা, চোখে এখনো ভাসে।
কিছুক্ষণ পরেই পুরো আকাশ ছেয়ে গেছে লাল আভায়। পাহাড়, মেঘের ওপর এমন লাল আভা চমৎকার সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছিল। মনে হচ্ছিল যেন কোনো দক্ষ শিল্পীর তুলির আঁচড়।
সকালে ফ্রেশ হয়ে চার বন্ধু রওনা করলাম কংলাক পাড়ার দিকে। আবারও সেই আঁকাবাঁকা জরাজীর্ণ পাহাড়ি পথে ছুটলো আমাদের চাঁদের গাড়ি। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে তুলোর মতো সাদা মেঘ। ছোট ফুটপাতের পরিচ্ছন্ন সাজেকের প্রথমে রুইলুই পাড়া। আমরা রাতে যেখানে ছিলাম সেটাই রুইলুই পাড়া। আর শেষ মাথায় কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় কংলাক পাড়া। দুই পাড়ার মধ্যে ৩০-৪০ মিনিট হাঁটার দূরত্বের কিছুটা পাকা আর কিছুটা মেঠোপথ। সাবধনতা অবলম্বন করে চলতে হয় পথ।
কংলাকের চূড়ায় না উঠলে সাজেক ভ্রমণ বৃথা। এখান থেকে সবুজ পাহাড় ও মেঘের সমুদ্র দেখে মনে হচ্ছিল, সর্বোচ্চ চূড়ায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির মায়ায় নিজেকে বেঁধে রাখি, থেকে যাই এখানেই।
Advertisement
এখানে লুসাই, পাংকুয়া ও ত্রিপুরাদের বসবাস। প্রকৃতির মত সুন্দর পাহাড়ের সহজ-সরল আদিবাসী মানুষের সংগ্রামী জীবন থেকে হয়তো অনেক কিছু শেখার আছে, যা বাস্তব না দেখলে নয়। কংলাক পাড়া থেকে ভারতের লুসাই পাহাড় দেখা যায়। সাজেকের পূর্বে ভারতের মিজোরাম আর উত্তরে ত্রিপুরা রাজ্য। পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা এবং দক্ষিণে রাঙ্গামাটির লংগদু।
কংলাক পাহাড় থেকে নামতে নামতে ফেরার ঘণ্টা বেজে গেল। ফেরার পথে সকালের নাস্তাটা শেষ করেই রওনা করলাম সকালের স্কোয়াডের সাথে। ঢালু রাস্তায় রোলার কোস্টারে চড়ার অনুভূতি নিয়ে সাজেককে পেছনে ফেলে খাগড়াছড়ি শহরের পথে।
সারাজীবন আপনাকে মনে রাখতে বাধ্য করবে, এমন অনেক কিছু আপনি নিয়ে আসতে পারবেন। সাজেক যাওয়া-আসার পথে আপনি দেখতে পাবেন হাজাছড়া ঝরনা। আসলে ঝরনার আসল রূপ হলো বর্ষায়। সাজেক বর্ষায় অন্য একরূপ নেয়। চারদিকে যেন সবুজের মিছিল। কখনো বৃষ্টি, কখনো মেঘের ভেলায় ভাসানো পাহাড়। এ যেন প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৌন্দর্য।
মেঘের রাজ্য সাজেক মুগ্ধ করেছে যতটা, তার চেয়ে বেশি ব্যথিত করেছে সেখানকার আদিবাসীদের জীবন ব্যবস্থার করুণ চিত্র। আমার দৃষ্টি সব সময় খুঁজে ফিরেছে জীবন বৈচিত্র্যের পার্থক্য। ফেরার পথে পাহাড়ি আদিবাসীদের শুধুমাত্র বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র বিহীন ঘর-বাড়ি আর জরাজীর্ণ শিশুদের পাহাড়ি রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থেকে হাত নাড়ানোর দৃশ্য আমার মনে দাগ কেটে গেছে।
বারবার মনে হয়েছে, এ অসহায় চোখের চাহনি আর হাতের ইশারা হয়তো কিছু বলতে চায়। হয়তো জানতে চায়, কেন আমরা এত অবহেলিত। সময়ের সাথে সাথে আমিও হয়তো ব্যস্ত হবো আমার বিভিন্ন কাজে। তাদের ওই নীরব প্রশ্নের উত্তর দিতে কখনো যাওয়া আর হবে কি না জানি না। তবে সারাজীবনের জন্য হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলোই হয়তো আমার বৃদ্ধ বয়সের খোরাক জোগাবে। এ আদিবাসী মুখগুলোই হয়তো বৃদ্ধ বয়সে সবার অবহেলায়ও নিজেকে চুপ থাকা শেখাবে।
এবার আসি আলুটিলা গুহায়–পাহাড়-পর্বত, ঝরনা বেষ্টিত এ খাগড়াছড়ি জেলাটি সারাবছরই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে। দৃষ্টিনন্দন ও রহস্যঘেরা বিভিন্ন স্থানের কারণেই এ পর্যটকদের কাছে এতো পছন্দের। তেমনই একটি দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্র হলো আলুটিলা। খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে মাটিরাঙ্গা উপজেলার আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে রয়েছে একটি রহস্যময় গুহা।
স্থানীয়রা একে বলেন মাতাই হাকড় বা দেবতার গুহা। তবে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে অবস্থিত বলে একে আলুটিলা গুহাই বলা হয়। এটি খাগড়াছড়ির একটি নামকরা পর্যটন কেন্দ্র। খাগড়াছড়ি বেড়াতে এলে সবাই অন্তত একবার হলেও এখানে ঘুরে যায়। এটি একটি চমৎকার পিকনিক স্পটও। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়, হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আলুটিলা খাগড়াছড়ি জেলার সবচেয়ে উঁচু পর্বত। নামে এটি টিলা হলেও মূলত এটি একটি পর্বতশ্রেণি। এখান থেকে খাগড়াছড়ি শহরের বেশ কিছু অংশ দেখা যায়। শুধু তাই নয়, পাহাড়ের সবুজ আপনার চোখ কেড়ে নেবে। আকাশ, পাহাড় আর মেঘের মিতালী এখানে মায়াবী আবহ তৈরি করে।
চলবে...
এসইউ/এমকেএইচ