জাতীয়

অপহরণের বিষয়ে যা বললেন চট্টগ্রামের সেই সাংবাদিক

চট্টগ্রামে অপহরণের শিকার হওয়া সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার দাবি করেছেন, তিনি অপহরণকারীদের মূল টার্গেট ছিলেন না। মূলত চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকদের ‘শায়েস্তা’ করতেই তাকে অপহরণ করা হয়েছিল।

Advertisement

সাংবাদিক সরোয়ার জানান, অজ্ঞাত স্থানে বন্দি থাকা অবস্থায় তিনি বেশ কয়েকবার অপহরণকারীদের কথোপকথন শুনতে পেয়েছেন। যেখানে অপহরণকারীরা কেউ একজনকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে কথা বলেছিলেন। এ সময় তিনি শুনতে পান, অপহরণকারীরা মোবাইলের অপর প্রান্তের লোককে বলছিলেন, ‘স্যার ফেলে দেব?’

অপরপ্রান্ত থেকে জবাব এলো, ‘না না... ও হলো ত্যানাফাডা (ছোটখাটো) সাংবাদিক, ওরে ফেলে লাভ নেই। ওরে দিয়ে অন্যদের শায়েস্তা করব। সাংবাদিকদের এখন আর বেইল (ভালো অবস্থান) নেই।’

সোমবার (২ নভেম্বর) অপহরণের সে বিভীষিকাময় সময়ের কথা উল্লেখ করে সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার বলেন, ‘অপহরণের দিন আনুমানিক রাত ১২টার দিকে নগরের জিইসি মোড় এলাকা হয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আলমাস সিনেমা হলের একটু আগে একটি লোকাল মোটরসাইকেলকে হাত দেখাই।’

Advertisement

এ সময় চালক কোথায় যাবেন জানতে চাইলে সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার বলেন, ‘নতুন ব্রিজ (শাহ আমানত সেতু) যাব’। কিন্তু মোটরসাইকেলটি কিছুদূর যেতেই চালক গাড়িটি ধীর করার সঙ্গে সঙ্গে অন্য আরেকজন ব্যক্তি পেছনে উঠে বসেন। গোলাম সরোয়ার বিষয়টির প্রতিবাদ করলে ওই ব্যক্তি চুপ থাকার আদেশ দিয়ে তার মুখমণ্ডলে কিছু একটা ঘষে দেন। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়।

সরোয়ার বলেন, ‘এর অনেকক্ষণ পরে আমি অনুভব করলাম, আমি একটি অ্যাম্বুলেন্সে চড়ছি। এর আরও বেশ কিছুক্ষণ পরে নিজেকে একটি মেঝেতে আবিষ্কার করি।’

এ সময় সরোয়ার তার অবস্থানের কাছাকাছি কোথাও ট্রেন যাতায়াতের শব্দ শুনতে পান। অপহরণকারীরা তাকে কিছু একটা দিয়ে পেঁচিয়ে চট্টগ্রামের ভাষায় জানতে চান, ‘আর নিউজ গরিবি না হ (আর নিউজ করবি কি না বল)’।

তার দাবি, এ সময় অপহরণকারীরা চারজন ছিলেন। যার একজন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলেন। বাকিরা ঢাকা এলাকার বাসিন্দা। এ সময় তাকে লোহার রড ও লাঠি দিয়ে মারধর করা হয়।

Advertisement

সোমবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যাশায়ী সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার সাংবাদিক নেতাদের এসব কথা বলেন।

রোববার (১ নভেম্বর) রাত ৮টার দিকে স্থানীয়রা সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী একটি খাল পাশের ঝোপঝাড় থেকে গোলাম সরোয়ারকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় গোলাম সরোয়ারের গায়ে একটি গেঞ্জি ও আন্ডারওয়্যার ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এর আগে গত ২৯ অক্টোবর সকালে চট্টগ্রাম নগরীর ব্যাটারি গলির বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে এ সাংবাদিকের আর খোঁজ মিলছিল না। এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে তার পরিবার ও সহকর্মীরা।

গোলাম সরোয়ার সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়ের স্টাফ রিপোর্টার এবং সিটিনিউজ নামের একটি অনলাইন পোর্টালের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উদ্ধারের সময় গোলাম সরোয়া‌রের গা‌য়ে সে‌ন্ডো গে‌ঞ্জি ও পর‌নে ছিল শুধু আন্ডারওয়্যার। স্থানীয় লোকজন উদ্ধার ক‌রে তা‌কে নি‌য়ে যান এক‌টি ডেকোরেটরে। সেখা‌নে তা‌কে দোকা‌নের ফ্লো‌রে অচেতন অবস্থায় শুই‌য়ে রাখা হয়। সেখা‌নে জ‌ড় হন অনেক লোক। হা‌জির হন পু‌লিশ, গণমাধ্যমকর্মীসহ অনে‌কে। একপর্যা‌য়ে গোলাম সরোয়ার‌কে স্থানীয় হাসপাতা‌লে নেয়ার জন্য চেষ্টা কর‌ছিল স্থানীয় লোকজন। এ সময় স‌রোয়ার সবার পা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে শুধু বলতে থাকেন, ‘ভাই, আমারে মাইরেন না। আমি আর নিউজ করব না।’

৭নং কুমিরা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আলাউদ্দিন জানান, উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে খাল পাড়ে ফেলে দিতে দেখে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করে রাস্তার পাশে ডেকোরেশনের দোকানে রাখেন। তখন তিনি কিছুটা কথা বলতে পারছিলেন।

স্থানীয় ওই ডেকোরেশনের মালিক বাবু বলেন, ‘আমি প্রস্রাব করতে খাল পাড়ে গেছিলাম। এ সময় পাশের ঝোপঝাড় থেকে আওয়াজ শুনছিলাম- ‘ভাই আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান।’ তখন আমি একা থাকায় সেদিকে যাইনি। দ্রুত দোকানে এসে আমার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে সেখানে গিয়ে সাংবাদিককে উদ্ধার করি।’

অপহরণকারীদের দ্বারা সাংবাদিকদের ‘শায়েস্তা’ করার বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুরো ঘটনাকে আমরা সাংবাদিকদের জন্য হুমকি হিসেবেই নিচ্ছি। কিন্তু এ কারণে আমাদের কলম বন্ধ হয়ে যাবে না। আমরা চাই, পুলিশ প্রশাসন অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনবে।’

কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাংবাদিক সরোয়ারের অপহরণের বিষয়ে যে বা যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে যা যা করণীয় সব করা হবে। এ বিষয়টি নিয়ে আরও তদন্তের বিষয় আছে।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘কেবল সংবাদ প্রকাশের কারণেই যে গোলাম সরোয়ারকে অপহরণ করা হয়েছিল তা এরইমধ্যে সুস্পষ্ট। গোলাম সরোয়ারকে অপহরণের সঙ্গে জড়িতরা যত প্রভাবশালীই হয়ে থাকুক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তা চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় সারাদেশের সাংবাদিকদের নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’

তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রাষ্ট্রের এত প্রতিষ্ঠান, সংস্থা থাকার পরও একজন সাংবাদিককে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হতাশাজনক। আমরা আশা করি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় এনে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে।’

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ম. শামসুল ইসলাম বলেন, ‘সাংবাদিক অপহরণের ঘটনা স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। এর সঙ্গে জড়িতরা পার পেয়ে গেলে ভবিষ্যতে কেবল স্বাধীন সাংবাদিকতা ঝুঁকির মুখে পড়বে, রাষ্ট্রের নাগরিকদেরও ভয়াবহ খেসারত দিতে হবে। তাই এ ঘটনায় জড়িতরা যত প্রভাবশালী হোক, যাদের দিয়েই এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকুক সকলকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

আবু আজাদ/এফআর/জেআইএম