রাত পৌনে ১০টা। কল্যাণপুর নতুন বাজারের একটি মাছের দোকানের কর্মচারী আব্দুল মালেক ঘরে ফিরেছেন মাত্র। হাত-মুখ ধুইয়ে খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। তখনই তার ঘরের পাশে নান্নুর টিনসেড ভাঙাড়ির দোকানে বিকট শব্দ হয়। এরপর ধোঁয়ার সঙ্গে উড়তে থাকতে আগুনের ফুলকি। আব্দুল মালেকের মতো আতঙ্কে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে বস্তিবাসী।
Advertisement
গত শুক্রবার রাত ১০টা ৩ মিনিটে এই বস্তিতে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের মোট ১৩টি ইউনিটের সোয়া এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও পুড়ে যায় ৭৩টি ঘর। রাতে তাদের ঠাঁই হয় খোলা আকাশের নিচে।
বস্তিবাসী বলছেন, বার বার আগুন লাগার কারণে বস্তিটি সবার কাছে ‘পোড়াবস্তি’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। কখনো নিজেদের অসাবধানতায়, কখনো দুর্বৃত্তদের আগুনে পোড়ে এই বস্তি। বেশ কয়েকবার উচ্ছেদের চেষ্টা চললেও বস্তিবাসীর পুনর্বাসন করা হয়নি। তাৎক্ষণিক ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি পুনর্বাসনের দাবি আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীর।
শনিবার সকালে সরেজমিনে পোড়াবস্তিতে দেখা যায়, ছোট ছোট ঘর পুড়ে মাটিতে কয়লার আকার ধারণ করেছে। পুড়েছে হাঁস-মুরগি, খাঁচাবন্দি কোয়েল পাখির বাচ্চাও। ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী নিজ নিজ পুড়ে যাওয়া ঘরে মেরামতের চেষ্টার পাশাপাশি অবশিষ্টাংশ উদ্ধার করতে ব্যস্ত।
Advertisement
নাজমুল হক নান্নুর ভাঙাড়ির দোকানের সঙ্গে লাগোয়া ঘর জাহাঙ্গীরের। তার নিজেরও ভাঙারির দোকান। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘রাতে বস্তির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ। এরপর আগুন আর আগুন। ৩০ গজ দূর থেকেও নিজের ঘরে আর ফিরতে পারিনি। লাখ টাকার দোকানের সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিছুই উদ্ধার করতে পারিনি।’
আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাঙারির দোকান থেকেই আগুন লাগে। প্রথমে বিকট শব্দ, এরপর দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।’
পোড়াবস্তিতে দুটো ঘর নিয়ে বসবাস করেন আরেক ভাঙারির দোকানি মো. লিটন। তিনি বলেন, ‘বস্তির নাজমুল হক নান্নুর ভাঙারি দোকানে প্রেসার মেশিনে বিভিন্ন লোহা, টিন আর প্লাস্টিক চাপ দিয়ে ছোট করার কাজ চলছিল। রাতে হঠাৎ মেশিনটিতে বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর সেখানে গ্যাসের সিলিন্ডারও বিস্ফোরিত হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে মালিক নান্নুর স্ত্রী আহত হন। এছাড়া দগ্ধ হন তার দুই কর্মচারী।’
লিটন বলেন, ‘বস্তিটি বারবার পুড়েছে। পুড়তে পুড়তে এর নাম হয়েছে পোড়াবস্তি। ৩০ বছর ধরে বসবাসের কারণে বস্তিটি আর ছাড়া হয়নি। পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হলে ৪ হাজার মানুষের বসবাসের এই বস্তিবাসীর জীবনে স্বস্তি ফিরবে।’
Advertisement
প্রায় তিন হাজার দুইশ পরিবারের বাস কল্যাণপুর নতুন বাজারের পোড়াবস্তিতে। বস্তিটি কয়েকবার উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকায় বর্তমানে উচ্ছেদ বন্ধ রয়েছে। তবে ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়ে যায় বস্তির ১২০টি ঘর। এর আগে ১৯৯০ এর দশকেও পোড়াবস্তিতে দুইবার আগুন লেগেছিল।
কল্যাণপুর ১১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেওয়ান আব্দুল মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে পাশে দাঁড়িয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে পাঁচ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩০ কেজি চাল ও দুই হাজার করে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বস্তির আগুনের কারণ সাধারণত শর্টসার্কিট, সিলিন্ডার গ্যাস কিংবা লিকেজ থেকে হয়। এখানে আগুনের কারণ কী তা জানতে আজ একটা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে। তদন্তেই জানা যাবে অগ্নিকাণ্ডের আসল কারণ।
জেইউ/এমএসএইচ/পিআর