বিনোদন

যেসব কারণে ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ গানের মালিকানা কারো হতে পারে না

দুজনেই অভিনয়ের আঙিনায় তারকাখ্যাতি পেয়েছেন। অসংখ্য নাটকে ব্যতিক্রমী সব চরিত্র দিয়ে মন ভরিয়েছেন দর্শকের। তারা উপহার দিয়েছেন অনেক দর্শকপ্রিয় সিনেমাও। তবে অভিনয়ের পাশাপাশি তারা গানেও বেশ সুপরিচিত। কণ্ঠের জাদুতে তারা মুগ্ধ করেছেন অসংখ্য শ্রোতার হৃদয়। বলছি চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওনের কথা। দুজনে মিলে একটি লোক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তারা। ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ শিরোনামের গানটি তাদের কণ্ঠে আলোচনায় এসেছে নতুন করে। এটি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।

Advertisement

২০ অক্টোবর গানটি প্রকাশ্যে আসে, যা পরে নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়। নতুন করে গানটির সংগীতায়োজন করেছেন পার্থ বড়ুয়া। আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেড বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের গান নিয়ে আয়োজন করেছে ‘আমাদের গান’ নামে অনুষ্ঠানের। সেই আয়োজনের অংশ হিসেবেই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন শাওন-চঞ্চল।

আইপিডিসর আয়োজনে নতুন করে আলোচনায় আসা এই গানের মালিকানা নিয়ে চলছে বিতর্ক। সরলপুর ব্যান্ড দাবি করছে এটি তাদের গান। কিন্তু আইপিডিসি তাদের কোনো অনুমতি নেয়নি। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে বিশ্লেষণ। এটি কি সত্যি সরলপুর ব্যান্ডের গান নাকি প্রাচীন কোনো লোকগান।

সেই আলোচনার ভিড়ে দারুণ কিছু তথ্য তুলে ধরে ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ গানটিকে চিরায়ত লোকগান এবং গানটির কপিরাইট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের নামে নিতে পারেন না বলে মন্তব্য করেছেন গবেষক ড. সাইমন জাকারিয়া। গানটি নিয়ে চলমান বিতর্কের ধারাবাহিকতায় সোমবার নিজের ইউটিউব চ্যানেলে বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ হাজির করেন এই গবেষক।

Advertisement

এদিকে কপিরাইট অফিস বলছে, কেউ যদি বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করে তবে তদন্ত সাপেক্ষে গানটির কপিরাইট সনদ বাতিল এবং শাস্তির আওতায় আনার সুযোগ রয়েছে।

সাইমন জাকারিয়া তার চ্যানেলে বলেন, বাংলার লোক-সংগীতের কোষগ্রন্থ ‘বঙ্গীয় লোক-সঙ্গীত রত্নাকর’ (দ্বিতীয় খণ্ড)। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছে ড. শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য। এটি ১৯৬০ সালে প্রকাশ হয়েছে। বইটির ৫৭৫ পৃষ্ঠার একটি গানের শুরুতেই আছে ‘সর্বজয় মঙ্গল রাধে বিনোদিনী রায়/ বৃন্দাবন মন্দিরে গাইব ঠাকুর কানাই’। গানটির শব্দচয়নের সঙ্গে সরলপুর ব্যান্ডের দাবিকৃত গানটির অনেকাংশে মিল রয়েছে।

গানটির একটি জায়গায় রয়েছে ‘বেজার কেন হব কানাই, বেজার কেন হব/ ভালো-মন্দ দুটি কথা কাছে কাছে বলিব...’। যেটি সরলপুর ব্যান্ডের তুরিন গেয়েছে, ‘বেজার কেন হও গো কানাই/ বেজার কেন হও গো/ ভালো-মন্দ দু-চার কথা তোমারে জানাইবো’। এছাড়া আশুতোষ ভট্টাচার্যের ‘বাংলার লোকসাহিত্য (দ্বিতীয় খণ্ড), যে অংশটিতে ছড়া মুদ্রিত রয়েছে। এটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬২ সালে। তার ঝাপাং পর্বে একটি গান মুদ্রিত আছে। যেখানে ২১২-২১৩ পৃষ্ঠায় একটি গানটি রয়েছে, সেখানে রাধার উদ্দেশ্যে কৃষ্ণের ফুল ছোঁড়ার একটি বর্ণনা আছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘কোথায় পাবো হাঁড়ি কলসি/ কোথায় পাবো দড়ি/ রাধে তুমি হও যমুনার জল/ আমি ডুইব্যা মরি...’।

বিভিন্ন প্রকাশনায় গানটির দৃষ্টান্ত রয়েছে। এছাড়া বাউল শিল্পীদের গানের খাতায়ও গানটি পেয়েছি। পাবনার শ্রী নেপাল চন্দ্র দাশের একটি হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির ভেতরে ৯ পৃষ্ঠায় একটি গান আছে, সেখানে বলা হচ্ছে, ‘তোমার মতো সুন্দর রাধে পাইলে দিতো বিয়া...’। পরে কানাই বলছে, ‘আমার মতো সুন্দর রাধে যদি পেতে চাও/গলেতে কলসি বেঁধে যমুনাতে যাও/ কোথায় পাবো হাঁড়ি-কলসি/ কোথায় পাবো দড়ি/ তুমি হও যমুনার জল/ আমি ডুবে মরি...’।

Advertisement

এরকম দৃষ্টান্ত থাকার পর গানটির স্বত্বাধিকারী হিসেবে কেউ নিজেদের দাবি করতে পারেন না বলে জানান সাইমন জাকারিয়া। তিনি বলেন, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা লোকায়ত গান এটি। বেশ কয়েক বছর আগে সরলপুর ব্যান্ডের ম্যানেজার আলামিন এক ইন্টারভিউতে বলেছেন, ‘গানটি এক বাউল এবং তার স্ত্রীর কাছ থেকে শুনেছি, তারা এটাকে বলতেন প্রেমলীলা’। আলামিন কিন্তু ঠিক কথা বলেছেন, এই গানটি তারা সংগ্রহ করেছেন একজন বাউলের কাছ থেকে। যদিও তারা সেই বাউলের নামটি বলেননি, বাউল ও তার স্ত্রীর নামটি বলা উচিত ছিল।

গানটি নিয়ে সরলপুর ব্যান্ড তাদের লিখিত বক্তব্যে বলেছে, ‘গানটি আমরা লেখা শুরু করি ২০০৬/২০০৭ সাল থেকে। তখনকার সময়ে আমরা কয়েকজন একদিন রাতব্যাপী পালাগান দেখতে যাই। যেখানে রাধাকৃষ্ণ সম্পর্কিত বিভিন্ন পালাগান হয়েছিল। যা আমাদের খুবই ভালো লাগে। তারপর থেকে রাধাকৃষ্ণ’র গল্পের ওপর নির্ভর করে আমরা এ গানটি লেখা শুরু করি। রাধা কৃষ্ণের গল্প থেকে আমরা বিভিন্ন তথ্য-ভাবধারা, শব্দচয়ন সংগ্রহ করে থাকি। কিন্তু কোন হুবহু কথা আমরা সংগ্রহ করিনি। আমাদের এ গানের সাথে কোথাও কোন গানের হুবহু মিল নেই। গানের গীতিকার এবং সুরকার তারিকুল ইসলাম তপন। গানটি আমরা সম্পূর্ণ রূপে কীর্তন ও লীলা কীর্তনের ওপর নির্ভর করে সুর করেছি। কীর্তন ও লীলা কীর্তনের ভাবধারা গানটিতে আনার চেষ্টা করেছি। ‘যুবতি রাধে’ গানটি আমরা ২০১০ সালে ময়মনসিংহ ও শেরপুরে আমরা কনসার্টে পরিবেশন করি। ২০১২ সালে চ্যানেল নাইনে আমরা এ গানটিসহ সাতটি গান আনরিলিজ ট্র্যাক হিসেবে প্রকাশ করি। ২০১৮ সালে আমরা সরলপুর ব্যান্ডের ১২টি মৌলিক গানের সনদ নিয়ে থাকি, যার মধ্যে একটি ‘যুবতি রাধে’। সরলপুর ব্যান্ডের এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টি মৌলিক গান রয়েছে।’

এদিকে স্বত্বাধিকারীর অনুমতি ছাড়া গান প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের ৭১ ধারার লঙ্ঘন বলে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী জানান। এই ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে কপিরাইট আইনের ৮২ ধারায় ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে বলে জাগো নিউজকে জানান কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী।

তিনি আরও বলেন, ‘যখন এ গানটি নিয়ে পূর্বে আরও একবার ঝামেলা তৈরি হয়েছিলো তখন আমরা বিশ্লেষণ করে দেখলাম যে মৈমনসিংহ গীতিকার ‘যুবতী রাধে’ গানটিতে মোট ৪২টি বাক্য বা লাইন রয়েছে। ওই গানের শেষের তিনটি লাইনের ভাবের সঙ্গে সরলপুর ব্যান্ডের গানটির মিল আছে। কিন্তু হুবহু বাক্যের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। যার ফলে এটি যে মৈমনসিংহ গীতিকার ওই গান তা সঠিক নয়। এ কারণে আমরা ‘যুবতী রাধে’ গানটির রেজিস্ট্রেশন সরলপুর ব্যান্ডের নামেই বহাল রেখেছি। সেটা যদি কেউ চ্যালেঞ্জ করে তথ্য প্রমাণ দেখাতে পারে তবে গানটি নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ রয়েছে।’

গবেষক ড. সাইমন জাকারিয়ার বক্তব্য দেখতে ক্লিক করুন

এলএ/পিআর