স্বাস্থ্য খাতে এডহক ভিত্তিতে চিকিৎসক নিয়োগে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষের লেনদেন হয়ে থাকে। এছাড়া তৃতীয় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে ঘুষ লেনদেন হয় ১ থেকে ৫ লাখ টাকা। বদলিতে ঘুষ আদান প্রদান হয় ১ লাখ থেকে ২ লাখ টাকা। তবে একই কর্মস্থলে একজন চিকিৎসক অবস্থান করতে আড়াই লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে থাকেন। আর বিভাগীয় পদোন্নতি পেতে ঘুষ দেন ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। দুর্নীতি বিরোধি সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি’র এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সংস্থাটি স্বাস্থ্য খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে ১৭ দফা সুপারিশ করেছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাসলিমা আক্তার।বৃহস্পতিবার রাজধানির একটি হোটেলে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যখাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশের স্বাস্থ্যখাতে বিদ্যমান একাধিক সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে এখাতের উন্নয়নে এসব সুপারিশ করা হয়। তবে প্রতিবেদনে আর্থিক অনিয়ম ও ঘুষ আদান প্রদানের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য তুলে ধরা হয়নি, এমন প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এটি একটি গুণগত প্রতিবেদন। কোন জড়িপ নয়। তবে প্রয়োজনে কিছু ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়েছে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাডহক চিকিৎসক ও কর্মচারী নিয়োগে দলীয় তদবিরের পাশাপাশি নিয়ম-বহির্ভুত অর্থের লেনদেন হয়। অ্যাডহক চিকিৎসক ও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মবর্হিভ‚তভাবে ১-৫ লক্ষ টাকা, বদলির জন্য ১০ হাজার থেকে ১০ লক্ষ টাকা এবং ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটি (ডিপিসি)’র মাধ্যমে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৫-১০ লক্ষ টাকার ঘুষের আদান-প্রদান হয়। এসব অনিয়ম ও লেনদেনে দলীয় নেতা, কর্মচারী ইউনিয়ন নেতা, অফিস প্রধান সহকারী, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একাংশের যোগসাজোসের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, চিকিৎসকদের সাথে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশনভিত্তিক অলিখিত চুক্তির মত অনৈতিক কর্মকার্তাদের অভিযোগ রয়েছে। ডাক্তারদের ক্ষেত্রে এ কমিশনের হার ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ এবং দালালদের ক্ষেত্রে কমিশন ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে।টিআইবি বলছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের চিকিৎসাসেবাদানকারী ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের জনবল ব্যবস্থাপনা, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ক্রয়, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাপনা, সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের সেবা কার্যক্রম, এবং বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের তদারকি ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনা করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। গবেষণার পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, দি মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) (অর্ডিন্যান্স), এবং দি মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস্ অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্স বলবৎ থাকলেও এগুলো যুগোপযোগী না হওয়ায় চিকিৎসকের অবহেলার কারণে কোনো রোগীর মৃত্যু বা ক্ষতি হলে তাঁর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বিনানুমতিতে কাজে অনুপস্থিতির ও বিলম্বে উপস্থিতির জন্য শাস্তির বিধান থাকলেও তার প্রয়োগ অত্যন্ত সীমিত। অনেক ক্ষেত্রে আবার শাস্তির পরিমান অত্যন্ত নগণ্য। প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মোট জনবলের ২০ শতাংশ পদ শূন্য রয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যমান জনবলের অনুপাত বিশ্ব মানদন্ড অনুপাতে খুবই কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদÐ অনুযায়ী চিকিৎসক জনসংখ্যা অনুপাত ১ঃ৬০০ হলেও বাংলাদেশে এটি ১ঃ৩২৯৭ যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে ডাক্তার ও নার্সের স্বীকৃত অনুপাত ১ঃ৩, বাংলাদেশে এ অনুপাত ১ঃ০.৪। ৬৪টি জেলার মধ্যে ২৬টি জেলায় ডেপুটি সিভিল সার্জন পদ তৈরী করা হলেও ছয়টি জেলায় উক্ত পদে পদায়ন নেই। হাসপাতালের সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিভিন্ন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনায় হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়া; হাসপাতালে বিভিন্ন কর্মকান্ড রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ/প্রভাব; হাসপাতাল অভ্যন্তরে দালাল দ্বারা হয়রানির শিকার ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে। গবেষণার ফলাফলের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সমস্যা থেকে উত্তরণে টিআইবি’র পক্ষ থেকে ১৭ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা; বিভিন্ন শূন্য পদ পূরণে দ্রæত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; জনবল নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা দূর করা; পদোন্নতিতে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে যোগ্যতার বিভিন্ন সূচকে স্কোরিং ব্যবস্থা চালু করা; পেশাজীবী সংগঠনগুলোর দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা; স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সংসদ সদস্যদের সক্রিয় উদ্যোগে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো কার্যকর করা; রোগীর তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি হাসপাতালে তথ্য ও অনুসন্ধান ডেস্ক কার্যক্রম চালু করা; চিকিৎসকের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার ক্ষেত্রে তদন্ত সাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ; বিএমডিসি’র ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত চিকিৎসকদের ডিগ্রি/যোগ্যতাসহ তালিকা প্রকাশ এবং নিয়মিত হালনাগাদ করা; ক্রয়, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়া চালু করা; এবং বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ন্ত্রণে তদারকি কার্যক্রম ব্যবস্থা জোরদার করা।সংবাদ সম্মেলনে ড ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সুশাসন নিশ্চিত করে কার্যকরভাবে দুর্নীতি ও বহুমুখী অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এ খাতে অর্জন ও অগ্রগতি আরো অনেক ভাল হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অর্জিত অগ্রগতির স্থায়ীত্ব ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতের মত মৌলিক অধিকার খাতে আর্থিক বরাদ্দ বিব্রতকরভাবে নিম্নমানের; যার প্রভাবে স্বাস্থ্য অবকাঠামো, জনবল ও গুণগত চিকিৎসা সেবায় প্রত্যাশিত মান অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। আর্থিক বরাদ্দ উদ্বেগজনকভাবে নিম্নমুখী। এ অবস্থার পরিবর্তনে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সঠিকভাবে জাতীয় প্রাধান্য নির্ধারণ অপরিহার্য।
Advertisement