মতামত

কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টানুন

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

Advertisement

কিশোর গ্যাং বা মাস্তানের ব্যবহৃত স্মার্ট ডিভাইস বা ক্ষিপ্র সাজ-সজ্জা বর্তমানে বহুল আলোচিত বিষয়। তারা স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারে খুবই পটু। নানা ফন্দি-ফিকির ও কৌশল ব্যবহার করে কিশোর গ্যাং বা মাস্তানের দল আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার চোখে ধুলো দিয়ে প্রতিনিয়ত ভয়ংকর অপরাধ ঘটিয়ে চলেছে।

‘মাস্তান’ আমাদের দেশে একটি পরিচিত নেতিবাচক শব্দ। কেমন করে যেন এই শব্দের সাথে অল্পবয়সীদের গ্যাং বা ঘৃণিতদল শব্দটি যুক্ত হয়ে আরো ভয়ংকর নেতিবাচক হিসেবে সমাজে পরিচিতি পেয়ে গেছে। কিশোর গ্যাং বা মাস্তানের দলের উত্থান নতুন মনে হলেও তা মোটেও নতুন কিছু নয়। অনেক সময় আমাদের সিনেমা, উপন্যাসেও এসব মাস্তানদের চরিত্র তুলে ধরা হয়ে থাকে। যারা ছোটকালে নির্যাতিত হতে হতে একসময় বড় হয়ে ক্ষমতা অর্জন করে এবং ক্ষমতাধরদের জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদ করে। নিজের শক্ত পেশি উচিয়ে নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাঁড়ায়, উপকার করে এবং দর্শকদের হাততালি পায়। কিন্তু আমাদের গল্পের মাস্তান ও সমাজের বাস্তব মাস্তানদের মধ্যে বিস্তর ফাঁরাক লক্ষ্যণীয়।

বাস্তব সমাজে তারা ভিন্ন রূপে বিরাজ করছে। এখানে তারা চরম স্বার্থপর। নিজেরা লুটের দের ভূমিকায় থেকে বাচ্চা মাস্তানদের জন্ম দেয় তারা। পাহাড়-বন-নদী দখল, বিধবা, অসহায়দের সম্পত্তি দখল, সরকারি খাস জমি দখল, অবৈধ মাদক, জুয়া, পতিতা ব্যবসা, চুরি, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, হত্যা ইত্যাদি নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে ডজন ডজন মামলার আসামী হয়েও জনসম্মুখে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এদের অনেককে।

Advertisement

এদের ছত্রছায়ায় নানা বাহিনী, গ্রুপ, গং, গ্যাং জন্ম নিয়ে জালের মত অপরাধকর্মে নিয়োজিত থেকে সমাজে চরম অশান্তি তৈরি করে। আমাদের দেশে বখে যাওয়া-ছন্নছাড়া বিত্তশালী, ঘরপালানো ছেলেরা ছাড়াও– দরিদ্র, ভাসমান, এতিম, অভাবী শিশু-কিশোরদেরকে কুপথে প্ররোচিত করে অপরাধে নিয়োজিত করার জন্য এরা বহুলাংশে দায়ী। বর্তমানে শত শত কিশোর মাস্তান দলের নাম ও অবস্থান পত্রিকায় জানা যায়।

কিশোর মাস্তানরা দলবল নিয়ে চুরি-ডাকাতি, খুন-ধর্ষণ করে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাইবার অপরাধ করে। ব্যাংক জালিয়াতি, তথ্য বিকৃতি, চরিত্র হনন, গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য চুরির কাজেও তারা পটু। মোবাইল পর্ণোগ্রাফির প্রধান গ্রাহক তারা। তাই সারা বিশ্বে এখন তারা বিশেষ আতঙ্কের নাম। এদের তৎপরতা দিন দিন এত বেড়ে যাচ্ছে তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এই মুহূর্তে বলা দুষ্কর।

এর কারণ বহু। কিশোর মাস্তানরা শক্তিধর মাস্টারমাইন্ডের পরিচালনায় কাজ করে থাকে। সেটা শুধু তাদের দলপতিকে জানানো হয়। দলের কর্মীবাহিনী ফুট-ফরমায়েশ করতে করতে একসময় পয়সা নিয়ে ভয়ংকর হুকুম পালন করে থাকে। তাই তাদের কাজের মধ্যে ন্যায়-নৈতিকতার কোন বালাই থাকে না। কৃতকর্মের মারাত্মক ক্ষয়-ক্ষতির ব্যাপারে তাদের কোন আক্ষেপও থাকে না। যেটা সমাজের চোখে বড় ভয়ংকর। তাই তাদের কৃতকর্ম মুহূর্তেই অনেক পরিবারে বিষাদ ডেকে আনে।

ক্ষতিকর নানা বিষয়ের প্রতি আসক্তিতে নিমজ্জিত করে রাখা হয় এসব অল্পবয়সী সদস্যদেরকে। পরিবারের অবহেলায় বখে যাওয়া ছেলেটি দলে ভিড়ে গেলে সর্বপ্রথম মাদকের মধ্যে জড়িয়ে যায়। ফ্রি মাদক সেবন শুরু করানো হলেও আসক্তি বেড়ে গেলে ফ্রি মাদক প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়। এর ফলে নিজের মাদকের টাকা যোগাড়ের জন্য তাকে অপরাধ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এভাবে সে একসময় ভয়ংকর অপরাধ করতে শুরু করে। জটিল অপরাধে অংশ নেবার জন্য উন্নত মানের যোগাযোগ করাটা জরুরি। তাই তাদের হাতে সরবরাহ করা হয় আধুনিক নেটসংযোগ সুবিধা সম্বলিত স্মার্ট ডিভাইস।

Advertisement

আধুনিক সুবিধা সম্বলিত উন্নত স্মার্ট ডিভাইস দিয়ে ভার্চুয়াল জগতে তাদের অবাধ বিচরণ শুরু হয়ে যায়। আখড়ায় বসে সারা পৃথিবীর অপরাধ জগতের অন্ধকার সুড়ঙ্গের কর্মকাণ্ড তারা জেনে নেয়। নিজেদেরকে মোবাইল ফোনের নীল ছবির পাতার আসক্তি থেকে যৌনতার আসক্তিতে নিয়ে যায়। এ ধরনের ঘৃণিত আসক্তি করেনাকালীন সময়ে ধর্ষণ প্রবণতা বেড়ে যাবার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। গ্যাং রেপ বা গণধর্ষণ বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পিছনে কিশোর গ্যাংয়ের ঘৃণিত প্রেষণা বহুলাংশে দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।

আজকাল সাধারণ ব্রডব্যান্ড ও কম্পিউটারে যে ওয়াই-ফাই ব্যবহার করা হয় তার চেয়ে মোবাইল ফোনের ফোন কোম্পানির ইন্টরনেটের স্পীড বহুগুণ বেশি। নগদ টাকায় কেনা মোবাইল ফোনের ইন্টারনেটের লাইন ফট করে কেটে যায় না। সাধারণত: বাসার কম্পিউটার বা ল্যাপটপ পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণও যৌথ ব্যবহার করে থকেন তাই সেগুলোতে নীল ছবির পাতার প্রতি আসক্তি জন্মানো ওদের জন্য সহজ নয়। সেক্ষেত্রে নিজের ছোট মোবাইল ফোন বা ডিভাইস শিশু-কিশোরদেরকে সহজেই অন্ধকার বা নিষিদ্ধ এডাল্ট ওয়েবপেজে নিয়ে যেতে সাহায্য করে থাকে। বর্তমান আমাদের দেশে অনলাইন শিক্ষার নামে কোটি কোটি শিশু-কিশোরদের হাতে এই অন্ধকার জগতে বিচরণের অবাধ সুযোগ তৈরি হয়েছে। তারা সারাক্ষণ স্মার্ট ডিভাইস হাতে নিয়ে চলে। রাতে-দিনে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে নীল ছবির পাতার আসক্তি থেকে যৌনতার দিকে মনোনিবেশ করতে উৎসাহী হয়ে পড়ে। এক শ্রেণির অজ্ঞ অভিভাবক এদের জন্য কোন ফায়ারওয়াল বা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা যায়- সেটাও জানেন না। ফলে, শিশু-কিশোররা স্মার্ট ডিভাইস হাতে নিয়ে অবাধে ভার্চুয়াল জগতে ঢুকে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করছে চারদিকে।

একদিকে নির্ঘুম রাত অন্যদিকে ঘরবন্দী ব্যায়ামহীন জীবন এবং হতাশা শিশুদের দৈহিক, মানসিক ক্ষতি করে ফেলছে। ইন্টারনেটে ক্ষতিকর কন্টেন্ট হাতড়াতে গিয়ে কিশোর গ্যাং,ব্লু -হোয়েল, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ছে।

আবার ক্রমাগত একঘেয়েমি থেকে বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে তারা। দেশে অফিস, বাজার, সিনেমা, গণপরিবহন সবকিছু খোলা- শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাটা যেন কোভিড-উনিশের দোহাই দিয়ে বিশের বিষে নীল হয়ে আগামী প্রজন্মকে ধ্বংস করার হাতছানি দিচ্ছে।

আরেকটি বিষয় হলো- মোটর বাইক। চাঁদাবাজি করা, ভীতি ছড়ানো এবং দুর্ঘটনা ঘটানো যেন এই বাহনটির প্রধান কাজ। বিশেষ করে লাইসেন্সবিহীন বাইক নিয়ে কিশোর মাস্তানরা শক্তিধর মাস্টরমাইন্ডের নির্দেশনায় অপারেশনে যায়। বিত্তশালী ঘরের সন্তান হবার কারণে এরা লাইসেন্সবিহীন বাইক নিয়ে ধরা পড়েও ছাড়া পায়। এটা আমাদের দেশের দুর্বল নীতি যা করুণ সামাজিক ও পারিবারিক পরিণতি তৈরিতে রসদ যোগানোর কাজ করছে।

একদিকে পারিবারিক অবহেলা অন্যদিকে সামাজিক প্রতিবাদহীনতা, প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব, এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক কমিটমেন্টের অভাব আমাদেরকে ভয়ংকর ভবিষ্যতের দ্বারপ্রান্তে হাজির করে ফেলেছে। সামাজিক সমস্যার ব্যাপারে যদি কোন সমাজে সামাজিক ঘৃণা ও প্রতিবাদ তৈরি না হয় তাহলে সেটা ভঙ্গুর হতে বাধ্য।

আমাদের দেশে সামাজিক ঘৃণা ও প্রতিবাদ তৈরির চেষ্টাকে মাস্তান দিয়ে ভন্ডুল করে দেয়া হচ্ছে। সুতরাং, কিশোর মাস্তানরা শক্তিধর মাস্টারমাইন্ডের পরিচালনায় আরো শক্তি-সাহস নিয়ে সাধারণ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেরী করছে না। তাই অচিরেই শিশু-কিাশোরদের স্মার্ট ডিভাইস, মোটর বাইক, মাদক ইত্যাদির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের জন্য একটি সরকারি বিধিনিষেধ তৈরি করা দরকার। বিশেষ করে শিশু-কিাশোরদের মোবাইল ফোনে এডাল্ট কন্টেন্ট, অবলা প্রাণিদের অশ্লীল ছবি অগ্নিদেয়াল দিয়ে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কিশোর অপরাধ তথা মানুষের নৈতিক চরিত্র হননকারী এসব ঘৃণিত ব্যবসা বন্ধ করার জন্য অনৈতিক সার্ভিস প্রোভাইডাদেরকে দ্রুত জবাবদিহিতার আওতায় আনা খুব জরুরি।

সব ধরনের অন্যায় ও পঙ্কিলতা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রেখে আগামীতে সবার জন্য একটি সুন্দর জীবনমান সৃষ্টির লক্ষ্যে কালবিলম্ব না করে এসব জটিল সামাজিক সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়াটার ওপর আমাদের সার্বিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

এইচআর/জেআইএম