বিশেষ প্রতিবেদন

ওষুধ সঙ্কটে ব্যাহত কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম

রাইতে (রাতে) জ্বর-জ্বর মনে হইছিল। আর মাথা ব্যাথা তো ছিলই। কিন্তু সকালে দেহি নাক দিয়া পানি পড়ে। তাই এই ক্লিনিকের ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ নিতে আইছি। ঠান্ডা-জ্বর আরা মাথা ব্যাথার ওষুধ চাইলে পাই। বড় ধরনের রোগের ওষুধ না পাইলেও আমাগো এহনে যা আছে, তাতেই কিছুটা চলে। কথাগুলো বলছিলেন মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার শিবচর ইউনিয়নের ময়নকাটা নদীর পাড়ে অবস্থিত ছোট চৌধুরীর বিল কমিউনিটি ক্লিনিকে আসা রোগী সৈয়দন নেছা (৬০)।

Advertisement

ওই ক্লিনিকে আসা রোগী নুর জাহান বেগম (৫০), নারগিস আক্তার (৩৫), সুমন (২৪) এবং রাজ্জাক আকন (৫৬) একই কথা বললেন। তারা মাথা ব্যাথা আর ঠান্ডা জ্বরসহ নানাবিধ রোগের ওষুধ নিতে আসেন।   তবে এলাকার মানুষের চাহিদা মতো ওষুধ দিতে না পারায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠির দোরগোড়ায় বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে বর্তমান সরকারের প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো খুব একটা কাজে আসছে না। ক্লিনিকগুলোতে বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক না থাকায় কাঙ্খিত স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। মাদারীপুর জেলার বেশিরভাগ কমিউনিটি ক্লিনিকের অবস্থা একই রকম। এ সকল ক্লিনিকে ওষুধ স্বল্পতা রয়েছে। আর স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী নিয়মিত উপস্থিত হন না। এ কারণে সরকারের উদ্দেশ্য সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না বলে সিএইচসিপি ও এলাকাবাসীরা মনে করেন। আর শুধু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে কয়েক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা (সিএইচসিপি)। তাদের সঙ্গে রয়েছে একজ স্বাস্থ্য সহকারী ও একজন করে পরিবার কল্যাণ সহকারী। এর ফলে বাধ্য হয়েই শহরের বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন তারা। মাদারীপুর জেলার শিবচর ইউনিয়নের ছোট চৌধুরির বিল কমিউিনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা কয়েকজন রোগীর সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এই প্রতিবেদকদের। রোগীরা জানান, ওষুধের জন্য কোনো মূল্য নেয়া হয় না। অামরা যে  রোগের জন্য ওষুধ চাই তার বেশির ভাগই এখানে থাকে না। প্রতি মাসেই এখানে ওষুধের স্বল্পতা থাকে। জেলার বেশির ভাগ কমিউিনিটি ক্লিনিকের ভিতরের শৌচাগার, পানির কল অকেজো। স্বাস্থ্য সহকারী, সিএইচসিপি ও পরিবার কল্যাণ সহকারীসহ এখানে আসা রোগীদের পয়ঃনিষ্কাশনের বেশ অসুবিধা হয় বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। সিএইচসিপি অ্যাসোসিয়েশন শিবচর উপজেলা সমিতির সভাপতি মো. জোবায়ের রহমান জাগো নিউজকে বলেন, এখন শুধু উন্নয়ন ফান্ডের জন্য রোগীদের কাছ থেকে দুই টাকা করে নেয়ার কথা থাকলেও রোগীরা কোনো টাকা দেয় না। কারণ আগে বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হতো। তাই রোগীরা উল্টে টাকা নেয়ার ব্যাপারে নানা প্রশ্ন করেন। তবে এই দুই টাকা দেয়া রোগীদের জন্য বাধ্যতামূলক নয় বলে স্বীকার করেন তিনি। স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, সকাল ৯টার মধ্যে ক্লিনিক খোলার কথা থাকলেও বেশ কিছু ক্লিনিক ১০টা পর্যন্ত তালাবদ্ধ থাকে। ছোট চৌধুরীর বিল কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি সবুজ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, তিনি প্রতিদিন সময়মতোই ক্লিনিকে আসেন। ওই ক্লিনিকের পরিবার কল্যাণ সহকারী গত ২৮ অক্টোবর-২০১৫ তারিখে এলপিআরএ চলে গেছেন। জেলার অন্যান্য চারটি উপজেলার কমিউিনিটি ক্লিনিকগুলোর চিত্র একই রকম। তবে প্রত্যন্ত এলাকার বেশিরভাগের অবস্থা খুবই নাজুক। এসব ক্লিনিকে প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ আর সংশ্লিষ্টদের নজরদারির অভাবে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা ভেস্তে যাচ্ছে। তবে ক্লিনিকগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ করে যদি ঠিকমতো নজরদারিতে রাখা যায় তাহলে সরকারের প্রচেষ্টা অনেকাংশেই সফল হবে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। মাদারীপুর জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মাদারীপুর জেলায় বর্তমানে ১২৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। এর মধ্যে শিবচর উপজেলায় ৪০টি, কালকিনি উপজেলায় ৩১টি, মাদারীপুর সদর উপজেলায় ৩৭টি, রাজৈর উপজেলায় ২০টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এসব ক্লিনিকে একজন করে সিএইচসিপি, একজন স্বাস্থ্য সহকারী ও একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী কর্মরত রয়েছেন। এ সকল কেন্দ্রে কোন ঝাড়ুদার কিংবা নাইট গার্ড না থাকায় নিজেদেরই ঝাড়ু দেয়াসহ নানা কাজ করতে হচ্ছে বলে দাবি করেন সিএইচসিপিরা। আর ক্লিনিকগুলোতে বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক না থাকায় রোগীদের পাশাপাশি বিপাকে পড়েছেন সিএইচসিপিরাও। এর ফলে সর্দি-কাশি, ঠান্ডা, জ্বর, মাথা ব্যাথা ও শরীর ব্যাথা বা ডায়রিয়ার মতো সাধারণ কিছু রোগ ছাড়া অন্য কোনো জটিল রোগের চিকিৎসা করতে পারছেন না সিএইচসিপিরা। নারী রোগীদের দুই একটি রোগের চিকিৎসা ছাড়া অন্য কোনো রোগের চিকিৎসা দিতে পারছে না তারা। তাই বাধ্য হয়েই রোগীদের শহরের বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে যেতে হচ্ছে।সিএইচসিপি মাদারীপুর জেলা সমিতির সভাপতি মো. লিয়াকত হোসেন সরদার জানান, আমাদের চাকরি বর্তমানে ট্রাস্টের অধীন। কিন্তু ২০১৩ সালের মধ্যে চাকুরি রাজস্ব খাতে নেয়ার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। আমরা অবহেলিত। আমাদের অনেকেরই সরকারি চাকরির বয়স নেই। তবুও আমরা আমাদের সাধ্যমতো রোগীদের ছোট-খাটো রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকি। এ সকল ক্লিনিক থেকে রোগীদের ৩০ ধরনের ওষুধ দেয়া হয়। তবে বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক না থাকায় রোগীদের জটিল কোনো রোগের চিকিৎসা বা ওষুধ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি। এ সকল ব্যাপারে জানতে চাইলে মাদারীপুর জেলার সিভিল সার্জন ডা. দিলীপ কুমার দাস জাগো নিউজকে বলেন, যাতে গ্রামীণ জনপদের রোগীরা সঠিক চিকিৎসা পায় সে কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকের বিষয়ে আমরা কঠোর তদারকি করছি। স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী সপ্তাহে তিনদিন অফিস করবে। আর সিএইচসিপি প্রতিদিনই অফিস করবে। তবে এ সকল কর্মচারীরা  যদি ঠিকমতো ক্লিনিকে না যান তাহলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও বলেন, কোনো ক্লিনিকে যদি কখনো ওষুধ সংকট দেখা দেয় তখন অতিরিক্ত চাহিদাপত্র দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধ নিতে পারবে। এ ব্যাপারে আমি প্রত্যেক উপজেলার টিএইচদের নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছি। তবে ক্লিনিকগুলোতে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।এসএস/আরআইপি