মতামত

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নারীশক্তির ব্যবহার

করোনাভাইরাস মহামারির কালে দেবী দুর্গা এসেছেন নারী চিকিৎসক রূপে, অসুররূপী করোনাভাইরাসকে বধ করছেন টিকা দিয়ে। দুর্গা পূজার সবচেয়ে শক্তিশালী দেবী প্রতীমা হিসেবে দুর্গার এই রূপ নজর কেড়েছে সবার। বিশ্বজুড়ে বছরব্যাপী মহামারির সাথে যুদ্ধ করছে মানুষ। একদম সামনের সারির যোদ্ধা হচ্ছেন চিকিৎসক। নারী চিকিৎসক ও সেবা কর্মীরা আক্ষরিক অর্থেই দশ হাতে সবকিছু সামলে মানুষ বাঁচানোর যুদ্ধে নেমেছেন, নারী বিজ্ঞানী টিকা আবিষ্কার করতে লড়ছেন। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নারীশক্তির অপরিহার্যতা ঘোষণা করেছেন দেবী দুর্গা।

Advertisement

অথচ, এই বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাস টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিলেন। বার জন সিনিয়র কর্মকর্তা আছেন এই টাস্কফোর্সে। আমেরিকাকে কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা করতে সব দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন এই বার জন, যাদের একজনও নারী নন।

২৯ ফেব্রুয়ারি টাস্কফোর্সের প্রধান ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স নিজের টুইটার একাউন্টে মিটিং-এর ছবি পোস্ট করলেন। মিটিংটা নাকি ‘খুবই কার্যকর’ ছিল। হোয়াইট হাউজের মিটিং রুমে টেবিলে বসে মিটিং যারা করছিলেন, তাদের একজনও নারী নন।

আমেরিকাতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মূল সর্বনাশটা ঘটলো জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। সর্বনাশ ঠেকাতে পুরুষ নেতৃত্ব কাজে এলো না। এরপর, মার্চের প্রথম দিকে, ডেবোরাহ্ বিরক্স এবং সীমা ভার্মা নামে দুইজন নারী কর্মকর্তাকে এই টিমে সংযুক্ত করা হয়। ডেবোরাহ্ বিরক্স দুর্যোগকালীন সাহায্য কিভাবে করতে হয়, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। সীমা ভার্মা চিকিৎসা সেবার প্রশাসক হিসেবে কাজ করেছেন বহু দিন। বহু দাবীর মুখে এই দুই নারী কর্মকর্তা কাজ করার সুযোগ পেলেন। কিন্তু, ততদিনে দেরি হয়ে গেছে খুব।

Advertisement

আমেরিকার থেকে শক্তি-সামর্থ্যে বহু গুণ পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশে শুরু থেকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জেন্ডার ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি তিনি মেনে চলেন। করোনাভাইরাস মহামারী ঠেকাতে বাংলাদেশ যে টাস্কফোর্স গঠন করেছিল, তাতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা’কে সদস্য সচিব করে ১৭ সদস্যের যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়, তাতে যোগ্যতার ভিত্তিতে সদস্য হিসেবে পুরুষ বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি নিযুক্ত হয়েছেন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শায়লা খাতুন এবং অবসট্রেরিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের প্রাক্তন সভাপতি অধ্যাপক রওশন আরা বেগম।

গোটা বিশ্বে পুরুষ নেতৃত্বের প্রাধান্য বেশি, রাজনীতি থেকে শুরু করে বাদ যায় না কোনো কিছুই। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে সব দেশেই নারীশক্তির উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাতের শতকরা ৭০ ভাগ নারীর সেবায় চললেও সিনিয়র অবস্থানে আসতে পেরেছেন এর মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ। এই হিসাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারই। উপস্থিতির হার বিবেচনায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নারীর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হতে পারত স্বাভাবিক ঘটনা। বিশ্বব্যাপী জেন্ডার অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়েও সচেতনতা আশা করা হয়। এর কোনটাই কোনো কোনো দেশে ঘটছে না। তবুও উঠে এসেছে সত্য। যেসব দেশে নারী নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহামারী প্রতিরোধে, সেসব দেশ সত্যিই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সংক্রমণ যতটা সম্ভব না ছড়িয়ে, জনকল্যানমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও মহামারির সময়ে বিপদে পড়ে যাওয়া জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে।

বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো আলাদাভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নারী নেতৃত্ব কেন সাফল্য দেখিয়েছে, তার কারণ অনুসন্ধান করে। প্রথম থেকেই বিষয়টিকে আমলে নিয়েছেন নারী সরকার প্রধানগণ, বাস্তবতা ও বিজ্ঞাননির্ভর অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তারা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু কীভাবে? আসলে নারী পরিবার সামলাতে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, তার আলোকে তিনি বৃহত্তর পরিসরে নেতৃত্ব দেন। পুরুষ কি এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেন না? এই প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন আসে, পরিবার সামলানোর অভিজ্ঞতা কি নারীর মতো পুরুষের নেওয়া হয় না? হয় না।

তবুও পুরুষতান্ত্রিকতার জোরে পুরুষ নেতৃত্ব নিয়ে ফেলে এবং যথারীতি নারী-শক্তির প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করে। ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে পশ্চিম আফ্রিকাতে ইবোলা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সময়েও নারীশক্তির প্রতি অবহেলা দৃশ্যমান হয়েছিল। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও একই ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ব এখনো বুঝে উঠতে পারেনি, অথবা বুঝতে চায় না দুর্যোগে নারী এবং শিশু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দুর্যোগ মোকাবেলা থেকে শুরু করে আবারো স্বাভাবিক অবস্থায় উত্তরণে নারীর অভিজ্ঞতালব্ধ পরামর্শকে আমলে নিতে হবে সবচেয়ে সেরা ফলাফল পাওয়ার জন্য।

Advertisement

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বোকামি কিন্তু কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কিংবা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো করেননি। লিঙ্গ সমতাকে মাথায় রেখে দুর্যোগ সামলাচ্ছেন। আমেরিকার মতো বেহাল দশা হয়নি এই দেশগুলোর। সাধারণ পোশাকে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেন ফেসবুক লাইভে এসে চার স্তরের লকডাউন প্ল্যানের কথা যখন বলছিলেন, তার ঠিক আগেই ঘুমিয়ে পড়া মেয়েটিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এসেছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত কর্মসূচিকে অনুসরণ করে সাফল্য খুঁজছেন।

নরওয়ে’র প্রধানমন্ত্রী এরনা সলবার্গ কেবলমাত্র শিশুদের সাথে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন যে নির্বাচিত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার অধিকার শিশুদেরও বিন্দুমাত্র কম নয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই ভিডিও কনফারেন্স করে সরাসরি বুঝতে চেয়েছেন কোথায় কোন্ ধরনের ঘাটতি পূরণ করা দরকার, কাকে উৎসাহ দিতে হবে, দুর্নীতি প্রতিরোধে হুঁশিয়ার করতে হবে, শাস্তি দিতে হবে, জনবহুল দেশটাতে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাকে স্মার্ট সল্যুশনের মাধ্যমে জনকল্যাণমুখী করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন।

এর পাশাপাশি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দৌড়ে শামিল বিজ্ঞানীরা, তাতে প্রথম সারিতেই দেখা মিলছে নারী বিজ্ঞানীদের। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষায় সবার আগে এগিয়ে আসছেন নারী। বিশ্ব থেকে চোখ সরিয়ে নিজেদের ঘরের ভেতরেই দেখি। করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন পুরুষ। সোশ্যাল ডিসটেন্সিং না মানার কারণে, ধূমপায়ী হওয়ার জন্যও পুরুষের বিপদ বেশি ঘটছে, মৃত্যুহারও বেশি। আক্রান্ত পুরুষ বুঝে কিংবা না বুঝে পরিবারের নারী ও শিশুদের আক্রান্ত করছেন।

আক্রান্ত পুরুষটিকে সেবা দিচ্ছেন নারী, তিনি নিজে আক্রান্ত হলেও গোটা পরিবারকে সেবা-শুশ্রূষার মূল কাজটি নারীকেই করতে হচ্ছে। পরিবারের আয় কমে গেছে, সীমিত খাদ্যের সুষ্টু ব্যবহার করে পরিবারের সদস্যদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বুদ্ধি করে কত কিছুই না করছেন নারী। তাহলে এই পরিস্থিতি কি কি করতে হবে, সে পরামর্শ দেওয়ার সময় শুধু পুরুষের মতটাকেই গ্রহণ করা হবে? নারীও যে ভাল পরামর্শ দিতে পারবেন, সেটা বুঝতে তো রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। লাগে কি? (পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম