যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট শুধুমাত্র তার দেশেরই নেতা নন। বরং তিনি এই গ্রহের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিও। তিনি যা করেন তা আমাদের সবার জীবন বদলে দেয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পও এর ব্যতিক্রম নন। তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক কীভাবে বিশ্বকে বদলে দিয়েছেন?
Advertisement
আমেরিকাকে যেভাবে দেখে বিশ্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবারই ঘোষণা দিয়েছেন, বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সম্প্রতি পিউ রিসার্চ সেন্টারের ১৩টি দেশের ওপর চালানো এক জরিপ বলছে, বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তির জন্য ট্রাম্প খুব বেশি কাজ করেননি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশে আমেরিকার ব্যাপারে মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির হার গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে পৌঁছেছে। যুক্তরাজ্যে আমেরিকার ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির এই হার ৪১ শতাংশ, ফ্রান্সে ৩১ শতাংশ; যা ২০০৩ সালের পর সর্বনিম্ন এবং জার্মানিতে মাত্র ২৬ শতাংশ।
গত জুলাই এবং আগস্টে চালানো পিউ রিসার্চের ওই জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকার ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে দেশটির করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলার কৌশল। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মাত্র ১৫ শতাংশ বলেছেন, করোনাভাইরাস মহামারি ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
Advertisement
জলবায়ু সঙ্কটে পিছুটান
বিবিসির রেবেকার সিলস বলেছেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে কী বিশ্বাস করেন তা বলা কঠিন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি ‘ব্যয়বহুল ছলনা’ থেকে শুরু করে ‘গুরুতর সঙ্কট’ বলেছেন; যা ‘আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ মনে হয়েছে।’’
হোয়াইট হাউসে আসার ছয় মাসের মধ্যে তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নিয়ে বিজ্ঞানীদের হতাশ করেন। বিশ্বে চীনের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। গবেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি আবারও নির্বাচিত হন, তাহলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে।
প্যারিস চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গ্রিন হাউস গ্যাসের আমেরিকান উৎপাদকদের ওপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণমূলক বিধি-নিষেধ বাতিলের অঙ্গীকার করেন। এটি ট্রাম্পের একটি প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তিনি দেশটিতে কয়লা, তেল এবং গ্যাসের উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের জন্য দূষণের একগাদা বিধি-নিষেধ বাতিল করে দেন।
Advertisement
তবে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু কয়লা খনি এখনও বন্ধ রয়েছে। রাষ্ট্রীয় সমর্থনে পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও স্বস্তায় প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের জন্য খনিগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশটির সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ১৩০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে কয়লার তুলনায় পুনর্নবায়নযোগ্য উৎস থেকেই সর্বাধিক জ্বালানির উৎপাদন হয়েছে।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী ৪ নভেম্বর কার্যকর হবে। তবে ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হলে এই চুক্তিতে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্র যোগ দেবে বলে অঙ্গীকার করেছেন ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন।
অনেকের জন্য সীমান্ত বন্ধ
গত নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মাত্র সপ্তাহ খানেকের মধ্যে অভিবাসন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের সাতটি মুসলিম দেশের অভিবাসীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত বন্ধ করেন তিনি। বর্তমানে বিশ্বের অন্তত ১৩টি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর ভ্রমণ বিধি-নিষেধের আওতায় রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের বসবাসের সংখ্যা ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মেয়াদের শেষ বছরের তুলনায় ৩ শতাংশ বেশি ছিল। তবে বর্তমানে অভিবাসীদের এই সংখ্যায় পরিবর্তন এসেছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনামলে মেক্সিকোতে জন্মগ্রহণকারী মার্কিন অধিবাসীদের সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। তবে লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সংশ্লিষ্ট ভিসাতেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে; বিশেষ করে দেশটিতে যারা বসবাস করছেন তাদের স্বজনদের জন্য।
অভিবাসন ঠেকাতে নির্বাচিত হওয়ার পরপরই মেক্সিকো সীমান্তে বিশাল প্রাচীর নির্মাণের অঙ্গীকার করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত এই সীমান্তে মার্কিন কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন বিভাগ ৩৭১ মাইল প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে। সীমান্তে আগের প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে সেখানে নতুন করে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়।
তবে আমেরিকায় পৌঁছানোর জন্য যারা মরিয়া; প্রাচীর নির্মাণের মতো কাজ তাদের ঠেকাতে পারেনি। গত ১২ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে সর্বোচ্চ সংখ্যক অভিবাসীকে আটক করা হয় ২০১৯ সালে। যাদের বেশিরভাগই পরিবারসহ যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন।
এর মধ্যে অধিকাংশই গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস ও এল সালভেদরের বাসিন্দা। সহিংসতা এবং দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত লাখ লাখ মানুষ আশ্রয় এবং নতুন জীবনের আশায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
২০১৬ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র অন্তত ৮৫ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। যদিও পরের বছর এই সংখ্যা ৫৪ হাজারে নেমে আসে। তবে আগামী বছর এই সংখ্যা ১৯৮০ সালের শরণার্থী গ্রহণ কর্মসূচি চালুর পর সর্বনিম্ন ১৫ হাজারে নেমে আসবে।
ভুয়া সংবাদের উত্থান
২০১৭ সালের অক্টোবরে এক স্বাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভুয়া সংবাদের ব্যাপারে কথা বলেন। যদিও মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট ভুয়া সংবাদ টার্মটি আবিষ্কার করেননি। তারপরও এটি বলা যেতে পারে, ভুয়া সংবাদ টার্মটি জনপ্রিয় করে তুলেছেন তিনি।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এ ব্যাপারে প্রথম টুইট করার পর থেকে এখন পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘ভুয়া সংবাদ’ টার্মটি প্রায় ২ হাজার বার ব্যবহার করেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট ও অডিও পর্যবেক্ষণকারী সাইট ফ্যাক্টবা জানিয়েছে।
আজ এই মুহূর্তে আপনি যদি ফেইক নিউজ লিখে গুগলে সার্চ করেন তাহলে ১০০ কোটিরও বেশি ফল পাবেন।
যেসব সংবাদের বিষয়ে তিনি একমত হতে পারেননি সেগুলোতে ফেইক নিউজের তকমা বার বার লাগিয়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৭ সালে এটি নিয়ে তিনি আরও এক ধাপ বেশি ব্র্যান্ডিং করে ফেলেন। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের শত্রু হিসেবে কয়েকটি গণমাধ্যমকে শনাক্ত করেন তিনি।
ট্রাম্পের এই ফেইক নিউজ টার্ম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফিলিপাইন, সৌদি আরব, বাহরাইন এবং বিশ্বের অন্যান্য কিছু দেশেও। বিরোধী দলীয় কর্মী এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন এবং দমনের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে অনেকেই সত্য সংবাদকে মিথ্যা আখ্যা দিতে শুরু করেন।
আমেরিকার অন্তহীন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য চুক্তি
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট অব দ্য ইউনিয়নে দেয়া ভাষণে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট টাম্প সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দেন। সেই সময় তিনি বলেন, মহান রাষ্ট্রগুলো অন্তহীন যুদ্ধে লড়ে না।
কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সিরিয়ায় তেলকূপ রক্ষায় প্রায় ৫০০ মার্কিন সৈন্য সেখানে রেখে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন ট্রাম্প। আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া থেকেও সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু এসব দেশে এখনও মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি রয়েছে।
সামরিক বাহিনী ছাড়াই মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের অনেক উপায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। বারাক ওবামা প্রশাসন পিছু হটলেও ২০১৮ সালে তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। একই সঙ্গে অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেন তিনি।
গত মাসে বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ইসরায়েলের ঐতিহাসিক সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তির মাধ্যমে নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ভোরের উদয় হয়েছে বলে প্রশংসা করেন ট্রাম্প। ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের এ দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের বাগাড়ম্বরপূর্ণ বিতর্কিত সব বিষয় বাদ দিলে তার প্রশাসনের অন্যতম কূটনৈতিক সফলতা হিসেবে দেখা যেতে পারে এই চুক্তিকে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে উপসাগরীয় অঞ্চলের তৃতীয় এবং আরব বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে আমিরাত এবং বাহরাইন।
বাণিজ্য চুক্তির রোষাণল
হোয়াইট হাউসে আসার প্রথম দিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে স্বাক্ষরিত ১২ দেশের বাণিজ্য চুক্তি ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপকে ভয়াবহ উল্লেখ করে তা বাতিল করেন। এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ায় লাভবান হয় চীন। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব সীমিত করার জন্য এই চুক্তিকে অন্যতম হাতিয়ার মনে করে বেইজিং।
কানাডা এবং মেক্সিকোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাক্ষরিত নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টের ব্যাপারেও নতুন করে আলোচনা তোলেন ট্রাম্প। এই চুক্তিকেও তিনি এ যাবৎকালের অন্যতম খারাপ বলে অভিহিত করেন। চুক্তির বিকল্পে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। তবে বেশ কিছু শ্রম আইন ও গাড়ির যন্ত্রাংশ কেনাবেচার বিধি-বিধানে কড়াকড়ি আনা হয়।
ট্রাম্পের এতকিছুর উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বিশ্ব বাণিজ্য থেকে লাভবান হতে পারে; সেটি নিশ্চিত করা। কিন্তু এর ফলে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দুই অর্থনীতির মধ্যে তিক্ত লড়াই শুরু হয়। পরস্পরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের পণ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ করে এ দুই দেশ। আর এটি যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন খাতের কৃষক, প্রযুক্তি ও অন্যান্য অটো শিল্পখাতের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
চীনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়; দেশটি থেকে বিভিন্ন উৎপাদনকারী কোম্পানি ব্যবসায়িক উৎপাদন ব্যয় কমাতে ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার মতো দেশে স্থানান্তরিত হয়। ২০১৬ সালের তুলনায় গত বছর চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি পায়। শুল্ক এড়াতে মার্কিন কোম্পানিগুলো চীন থেকে আমদানি কমিয়ে দেয়। চলতি বছরে করোনাভাইরাস মহামারির তীব্র প্রভাব সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র পণ্য রফতানির তুলনায় আমদানি করেছে বেশি।
চীনের সঙ্গে লড়াই ২০১৬ সালের ২ ডিসেম্বর ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পরপরই তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। ১৯৭৯ সাল থেকে পূর্বসূরীদের নীতি থেকে বেরিয়ে এসে তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনা করেন। ওই বছর এই দ্বীপ ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ছিন্ন করে।
চার বছর আগে বিবিসির চীনা বিভাগের সম্পাদক ক্যারি গ্রেসি ট্রাম্পের টেলিফোনে আলোচনায় বেইজিং ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। চীন তাইওয়ানকে একটি বিদ্রোহী প্রদেশ মনে করে। যদিও তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করে।
দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানা দাবিকে অবৈধ বলে চীন আখ্যা দেয়ার পর ওয়াশিংটন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি উল্লেখ করে চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয় অ্যাপ টিকটক ও উইচ্যাট নিষিদ্ধ, টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়েকে কালো তালিকাভূক্ত এবং চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। শুধুমাত্র ট্রাম্পের কারণেই বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের উত্তেজনা তৈরি হয়নি। বরং চীনও এজন্য কিছুটা হলেও দায়ী। ২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ব্যাপক বিতর্কিত হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন কার্যকর এবং সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের গণহারে বন্দি রাখায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোভাইরাসকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা ভাইরাস নামে আখ্যায়িত করেন। যদিও নিজ দেশে এই ভাইরাস মোকাবিলায় নেয়া পদক্ষেপের কারণে ট্রাম্পের সমালোচনা রয়েছে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রে নেতৃত্বে পরিবর্তন এলেও দুই দেশের বিবাদ মীমাংসা হবে তেমন কোনও ইঙ্গিত নেই। ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে দুর্বৃত্ত মন্তব্য করে বলেছেন, চীনের এই নেতার শরীরে গণতান্ত্রিক মেরুদণ্ড নেই।
ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ দশা
২০১৯ সালের নববর্ষের সন্ধ্যায় এক টুইট বার্তায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, মার্কিনিদের প্রাণহানি অথবা আমাদের যেকোনও স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতির দায় পুরোপুরি ইরানকে নিতে হবে। তাদের বিশাল মূল্য চুকতে হবে। এটা কোনও সতর্কবার্তা নয়। এটা সরাসরি হুমকি। শুভ নববর্ষ। এর কয়েকদিন পর ইরানের অত্যন্ত প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডার কাসেম সোলাইমানি মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হন। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন তিনি। প্রতিশোধে ইরাকে মার্কিন দুটি সামরিক ঘাঁটিতে এক ডজনের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। এতে যুক্তরাষ্ট্রের শতাধিক সৈন্য নিহত হয়। বিশ্লেষকরা সেই সময় জানান, উভয় দেশ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।
এ দুই দেশের মাঝে যুদ্ধ না হলেও এখনও নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু অব্যাহত আছে। ওই সময় ইরানের সামরিক বাহিনী ভুলেই ইউক্রেনের একটি যাত্রীবাহী বিমানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ভূপাতিত করে। এতে বিমানটির অন্তত ১৭৬ আরোহী মারা যান।
যুদ্ধদশা কীভাবে তৈরি হলো? পারস্পরিক অবিশ্বাসের বেশ কিছু ধারাবাহিক ভুল হিসেব-নিকেশের কারণে চিরবৈরী এ দুই দেশের মাঝে যুদ্ধদশা তৈরি হয়।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে এই অচলাবস্থার শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। ওই বছর ইরানে যুক্তরাষ্ট্রসমর্থিত শাহ শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতাচ্যুত হয়। তেহরানে নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের ভেতরে ৫২ আমেরিকানকে জিম্মি করা হয়।
২০১৮ সালের মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্ব শক্তির স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দেন। ২০১৫ সালে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের শর্তে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করতে রাজি হয়। কিন্তু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন ট্রাম্প।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরানের অর্থনীতি চরম মন্দার মুখোমুখি হয়। গত বছরের অক্টোবরে দেশটির খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ৬১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এমনকি দেশটিতে তামাকজাত পণ্যের দাম ৮০ শতাংশ বেড়ে যায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে চরম সঙ্কটের মুখোমুখি ইরানি রাস্তায় নেমে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ করে। যদিও ইরানের ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী কঠোর হাতে সেই বিক্ষোভ দমন করে।
সূত্র : বিবিসি।
এসআইএস/এমকেএইচ