মনিরুজ্জামান কবির
Advertisement
ইঁদুর আমাদের বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের একটি প্রাণী। জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে ইঁদুরের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সময়ে সময়ে ইঁদুর ফসল ও কৃষকের শত্রু হিসেবে হানা দেয়। জমির শস্য ও গোলার ফসল রক্ষার্থে ইঁদুর দমন করতে হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ব। বিভাগ ইঁদুর দমনে পেঁচা নিয়ে গবেষণা করছে।
আমরা জানি ইঁদুরের প্রধান শত্রু পেঁচা, চিল, সাপ, বিড়াল প্রভৃতি। পেঁচা দিয়ে জৈবিক উপায়ে ইঁদুর দমন করা গেলে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা পাবে। সেইসাথে কৃষকও স্বল্প খরচায় ফসলি জমির ও গোলার শস্য ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির থেকে রক্ষা করতে পারবে।
ইদুরের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণসম্প্রতি একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে প্রতিবছর দুই হাজার কোটি টাকার শস্য ইঁদুরের পেটে চলে যাচ্ছে । ইঁদুর যে শুধুমাত্র দানাদার ফসলের ক্ষতি করে তা নয়, এ অন্যান্য ফসল ও ফলমূল, আসবাবপত্র ক্ষতি সাধন করে, যেমন: নারিকেল, আলু, ডাল, অন্যান্য সবজি ইত্যাদি। বৈদ্যুতিক তার ও যন্ত্রপাতি এর হাত থেকে রেহায় পায় না। তাছাড়া ইঁদুর বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা ও কেটে নষ্ট করে, যার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক তবে তা মুদ্রা মানে ইতিপূর্বে খুব একটা হিসাব করা হয়নি।
Advertisement
সরকারি-বেসরকারি খাদ্য গুদাম, পাউরুটি ও বিস্কুট তৈরির কারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পাইকারী ও খুচরা পণ্য বিক্রেতার দোকানে বিপুল পরিমাণে খাদ্য ইঁদুর নষ্ট করছে এরও কোন হিসাব এখন পর্যন্ত করা হয়নি।সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের কাটাকাটির স্বভাব তার প্রকৃতিগত। যেমন: কাঠ বিড়ালী, সজারু, ইঁদুর ইত্যাদি। দাঁত ছোট রাখার জন্য এরা প্রতিনিয়তই কাঁটাকাটি করে।
যদি ইঁদুরের এ অভ্যাস বন্ধ রাখা হয়, তবে তার দাঁত অনেক বড় হয়ে যাবে। সুতরাং ছোট রাখার জন্য তাকে প্রতিনিয়তই কাটাকাটি করতে হয়। এক হিসাবে দেখা গেছে যে, ইঁদুর যে পরিমাণ ভক্ষণ করে তার দশগুণ সে কেটে নষ্ট করে।
বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রুত এবং বংশ বিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রম্মপুত্র অববাহিকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠাপানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশ বিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল। ফসলের মাঠ ছাড়াও এ অববাহিকায় অবস্থিত হাঠ-বাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতেও ইঁদুরের দাপট বেশি পরিলক্ষিত হয় (ইউএসডিএ, ২০১০)।
ইঁদুরের উৎপাতের কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় হিসাবে ১১টি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্ধেক জমির ফসল ইঁদুরের আক্রমণের শিকার হয়। বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ ধান, গম ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। ফসলের মোট ক্ষতির বিবেচনায় ইঁদুরের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ফিলিপাইন। দেশটির উৎপাদিত ধানের ২০ শতাংশ ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে।
Advertisement
এর পরেই আছে লাওস । দেশটির প্রায় ১৫ শতাংশ ধান ইঁদুরের পেটে যায় (ইরি)। ডিএই এর মতে ২০১০ সালে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৩৯ হাজার ৯৮৬টি ইঁদুর মারা হয়। এর ফলে দেড়লাখ টন ফসল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়। যার বাজার মূল্য ২২২ কোটি টাকা। বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গম ৪-১২ ভাগ, গোল আলু ৫-৭ ভাগ, আনারস ৬-৯ ভাগ নষ্ট করে। গড়ে মাঠ ফসলের ৫-৭% এবং গুদামজাত শস্য ৩-৫% ক্ষতি করে। ইঁদুর শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ সেচ নালাও নষ্ট করে থাকে।
সেটা ফসলের উৎপাদনের উপর প্রভাব ফেলে। ইরির ২০১৩ সালের এক গবেষণা মতে, এশিয়ায় ইঁদুর বছরে যা ধান-চাল খেয়ে নষ্ট করে তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। আর শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে।
তাছাড়া ইঁদুরের মাধ্যমে মোট ৬০ ধরণের রোগ ছড়ায়। ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে মুরগির ডিম ও ছোট বাচ্ছা খেয়ে ফেলে। বারি এর অমেরুদণ্ডী প্রাণী বিভাগের হিসাবে ইঁদুর দেশের প্রতিটি মুরগির খামারে বছরে ১৮ হাজার টাকার ক্ষতি করে।
ইঁদুরের আশ্রয়স্থানসমূহগ্রীষ্ম মৌসুমে ইঁদুর সাধারণত ফসলের ক্ষেতে ও গ্রাম এলাকার বিভিন্ন স্থানে গর্ত করে সেখানে অবস্থান করে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে নিন্মভূমি প্লাবিত হলে এবং ফসলের জমিতে বৃষ্টির পানি জমলেই ইঁদুর গিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উঁচু গ্রামীণ সড়ক, বেড়িবাঁধ ও পুরোনো স্থাপনায় ইঁদুরের দল গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ অবকাঠামোগুলো কাঁটাকাটি করে ইঁদুর বাসা তৈরি করে। বর্ষা এলে জোয়ার-ভাটার পানির মতো ইঁদুরও বেড়িবাঁধগুলোর জন্য অভিশাপ হয়ে আসে।
জোয়ার ও পানি ফসলের মাঠ ডুবিয়ে দিলে ইঁদুর এসে বেড়িবাঁধ ও গ্রামীণ সড়ক ফুটো করে সেখানে আশ্রয় নেয়। আর ঐ ফুটো দিয়ে পানি প্রবেশ করে বেড়িবাঁধ ও সড়কগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
ইঁদুর আক্রান্ত ধান ক্ষেতের লক্ষণসমূহইঁদুর ধানগাছের কুশি তেছড়া করে (৪৫ডিগ্রি) কেটে দেয়। ধান পাকলে ধানের ছড়া কেটে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে জমা রাখে। ধানের জমিতে মাঠের বড় কালো ইঁদুর, মাঠের কালো ইঁদুর প্রধানত ক্ষতি করতে দেখা যায়। গুদামঘরে শস্য গেছো ইঁদুর ক্ষতিসাধন করে।
দমন ব্যবস্থাপনাইঁদুর দমনে বিভিন্ন ধরণের যান্ত্রিক (যেমন-লাইট ট্র্যাপ, স্ন্যাপ ট্র্যাপ), রাসায়নিক (যেমন-ফসটক্সিন, মিথাইল ব্রোমাইড) ব্যবহার হচ্ছে। ইঁদুর ধানের জমিতে ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে জীবন্ত ফাঁদ সবচেয়ে কার্যকরী। ফাঁদে টোপ হিসেবে শামুকের মাংস, ধান, নারিকেলের শাঁস, কলা ও শুঁটকি মাছ ব্যবহার করলে ইঁদুর বেশি ধরা পড়ে। তাছাড়া ধান বা চালের সাথে নারিকেল তৈল টোপ হিসেবে ব্যবহার করলে বেশ কার্যকরী ফলাফল পাওয়া যায়। শস্য গুদাম এবং বসতবাড়িতে ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে আঁঠাযুক্ত ফাঁদ বেশি কার্যকরী।
ব্যবস্থাপনার জন্য:১. জমির আইল ও সেচ নিষ্কাশন নালা কম সংখ্যক ও চিকন রাখতে হবে।২. একটি এলাকায় যথাসম্ভব একই সময় ধান রোপণ ও কর্তন করা যায় এমনভাবে চাষ করতে হবে।৩. ফাঁদ পেতে ইঁদুর দমন করুন।৪. বিষটোপ, যেমন- ব্রমাডিওলন দিয়ে ইঁদুর দমন করা যায়।৫. ইঁদুরের নতুন গর্তে ফসটক্সিন বড়ি দিয়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে দিন।
লেখক: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আঞ্চলকি র্কাযালয়, বরশিাল।mkabir1986@gmail.com
এমএমএফ/এসইউ/এএ/এমএস