বিশেষ প্রতিবেদন

ওষুধ নেই রোগীও নেই

ওষুধ নেই। তাই রোগীও নেই। ফলে তালা ঝুলছে নরসিংদীর বেশিরভাগ কমিউনিটি ক্লিনিকে। এতে ভেস্তে যাচ্ছে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। সব মিলিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে নরসিংদী জেলার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর কার্যক্রম। আর যে সকল কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা দিয়ে যাচ্ছে সেগুলোতে পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ না থাকায় দিন দিন কমছে রোগীর সংখ্যা। সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক জনগণ। তবে হেলথ প্রোভাইডারদের দাবি এক সময় নিম্নবিত্তরা সেবা নিলেও এখন সমাজের বিত্তবানরা এই প্রকল্পের আওতায় সেবা নিচ্ছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু করে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প। প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ১০ হাজার ৭৩২টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। এরই অংশ হিসেবে অবকাঠামো নির্মাণ ও লোকবল নির্মাণ করে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হলেও বিগত জোট সরকার কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের নবম একনেক সভায় ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ (কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প) শীর্ষক ৫ বছর মেয়াদী উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়। নরসিংদী জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের আওতায় প্রতি ৬ হাজার জনসংখ্যার জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়।  জেলার ছয়টি উপজেলায় মোট ২০১টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৩৩টি,পলাশ উপজেলায় ১৩টি, শিবপুরে ৩৭টি, রায়পুরা উপজেলায় ৫৭টি, মনোহরদীতে ৩৯টি ও বেলাবো উপজেলায় ২৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এ সকল ক্লিনিকের হেলথ প্রোভাইডারকে (সিএইচসিপিকে) ৩ মাস ব্যাপি চিকিৎসা সেবার উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এরই ভিত্তিতে তারা রোগীদের প্রাথমিক সেবা প্রদান করে থাকেন। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো থেকে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য পরিচর্যা, শিশু রোগের সমন্বিত চিকিৎসা সেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত শিক্ষা ও পরামর্শ, সাধারণ রোগ ও জখমের চিকিৎসাসেবা প্রদান করছে। পাশাপাশি জরুরি ও জটিল রোগীদের রেফারের মাধ্যমে সেবা দিয়ে যাচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক।শুরুর দিকে সরকারের এই প্রকল্প সফল প্রকল্প হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।  হাতের নাগালে মান সম্মত চিকিৎসা সেবা ও বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়ায় অভিভূত ছিল চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ মানুষ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সরেজমিনে নরসিংদী সদর, শিবপুর ও পলাশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ কমিউনিটি ক্লিনিকে তালা ঝুলছে। নেই হেলথ প্রোভাইডার, পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও হেলথ এসিস্ট্যান্ট। সদর উপজেলার ঘনবসতি এলাকা হাজিপুরের চকপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, হেলথ প্রোভাইডার রত্মা নন্দী বসে আসেন। তবে রোগী নেই। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি ওষুধ দেয়া হয়। প্রতিদিন প্রায় কমবেশি ৮০/৯০জন রোগী আসে। তবে বর্তমানে রোগীর সংখ্যা কম। কারণ গত এক সপ্তাহ আগে সরবরাহকৃত ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। তিনি আরো জানায়, প্রতি ২-৩ মাস অন্তর অন্তর ২৯ ধরনের দুই কার্টুন করে ওষুধ সরবরাহ করা হয়। এখন ওষুধ নেই। তাই রোগীও কম।  বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বদরপুর এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায় তালা ঝুলছে। জানতে চাইলে সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধা জানায়, এখানকার ডাক্তার আমার নাতনি। সে এখন বাড়িতে আছেন। খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ক্লিনিকের হেলথ প্রোভাইডার পাপিয়া আক্তার আসেন। তিনি জানায়, গত দুই মাস যাবৎ ওষুধ সরবরাহ নেই। তাই রোগীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কম। তাছাড়া জেলা ও সদর হাসপাতাল কাছাকাছি থাকায় অনেক রোগী সেখানে চলে যায়।সবচেয়ে ভয়ানক চিত্র দেখা যায় সদর উপজেলার চরাঞ্চল ও শিবপুর উপজেলায়। এর মধ্যে একটি হলো শিবপুর উপজেলার শেরপুর কমিউনিটি ক্লিনিক।  ক্লিনিকের সামনে অবস্থিত মুদি দোকানি তারেক মিয়া জানায়, গত ৪/৫ মাস যাবৎ বন্ধ রয়েছে ক্লিনিকটি। মাঝে মধ্যে খোলা হলেও তা খুবই নগণ্য। অপর এলাকাবাসী মোজাম্মেল বলেন, সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত রোগীদের সেবা দেয়ার নিয়ম থাকলেও এখানকার দায়িত্বরত হেলথ প্রোভাইডার বেলা ১১টা সাড়ে ১১টায় আসেন। আবার ১টার দিকে ক্লিনিক বন্ধ করে চলে যান।  একই চিত্র জেলার বেশির ভাগ ক্লিনিকগুলোতে। সরকারি বেধে দেয়া নিয়ম মানছেন না হেলথ প্রোভাইডাররা। সার্বিক তত্ত্বাবধানের অভাবে সুযোগ নিচ্ছেন হেলথ প্রোভাইডাররা। ফলে কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামের সাধারণ মানুষ। তবে এর উল্টো চিত্রও মিলেছে বেশ কিছু কমিউনিটি ক্লিনিকে। সে সকল ক্লিনিকগুলোর  মধ্যে একটি সদর উপজেলার ঘোড়াদিয়া কমিউনিটি ক্লিনিক। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ক্লিনিকে এক একে রোগী আসছে। সেবার পাশাপাশি ওষুধ নিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে কথা হয় রোগী আমেনা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানায়,গর্ভবতী হওয়ার পর থেকেই গত ৬ মাস যাবৎ এখান থেকে সেবা নিচ্ছেন তিনি। সেবার পাশাপাশি ক্লিনিক থেকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দেয়া হচ্ছে।  ঘোড়াদিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ প্রোভাইডার সোহেল আব্বাস দাবি করে বলেন, এটা একটি সফল প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এর ফলে এক সময় নিম্নবিত্তরা সেবা নিলেও এখন সমাজের বিত্তবানরা এই প্রকল্পের আওতায় সেবা নিচ্ছেন। ফলে দিন দিন বাড়ছে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে রোগীর সংখ্যা। কিছু কিছু কমিউনিটি ক্লিনিক মাঝে মধ্যেই বন্ধ রাখা হচ্ছে। হেলথ প্রোভাইডারা ঠিক সময়ে অফিস করছে না এমন অভিযোগের কথা স্বীকার করেছেন খুদ জেলা সিভিল সার্জন পুতুল রায়। তিনি বলেন,কিমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বিশেষত উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারাই দেখাশোনা করেন। ওষুধ সরবরাহ করা হয় কিমিউনিটি ক্লিনিকের নিজস্ব প্রকল্প থেকে। সে কারণেই সব সময় ২০১টা ক্লিনিক আমার একার পক্ষে পরিদর্শন করা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর ব্যাপারে যে সকল অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো দূর করতে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের আরো সক্রিয় হতে হবে। তবে হেলথ প্রোভাইডাদের গাফিলতি দূর করাসহ কমিউনিটি ক্লিনিকের সবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।এসএস/এমএস

Advertisement