ফারাবি বিন জহির
Advertisement
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। নিঃসন্দেহে শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। শিক্ষার আলোয় আলোকিত ব্যক্তি এবং জাতি সবসময় উন্নতি ও অগ্রগতির শীর্ষে অবস্থান করে। কিন্তু শিক্ষা তখনই এরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করতে সমর্থ হবে যখন তা হবে উপযুক্ত মানসম্পন্ন। আর এই উপযুক্ত ও মান সম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের কাজটি করে থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই অবধারিত সত্য হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে করোনাকালে অন্যান্য খাতের মত শিক্ষাখাত ও ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশ করোনা আক্রান্ত হবার শুরুর দিকে গত ১৭ মার্চ হতে সরকার শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। এই পৌনে ছয় কোটি শিক্ষার্থী তখন হতে ঘরবন্দি, সঙ্গে ছিল কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও। বাংলাদেশ জুড়ে প্রাইমারি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত(প্রায় পৌনে ছয় কোটি)যে পরিমাণ শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করে তা পৃথিবীর অনেক দেশের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। হঠাৎ করে করোনার ছোবল শিক্ষা ব্যবস্থায় পরার ফলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা হতবিহ্বল হয়ে ওঠে। যেহেতু করোনার অভিজ্ঞতা ছিল বাংলাদেশের জন্য নতুন তাই অন্যান্য খাতের মত এই খাতটিকেও বেশ বেগ পেতে হয় এই সংকট মোকাবেলায়।
পরবর্তীতে এই সংকটকে সামনে রেখে আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। যদিও এই অনলাইন ক্লাসকে ঘিরে কম জল ঘোলা হয়নি। যেহেতু বাংলাদেশে সব অঞ্চলে ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ক সমান শক্তিশালী নয় তাই এই অনলাইন ক্লাস করতে বেশ বেগ পেতে হয় শিক্ষার্থীদেরকে। এছাড়াও নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীর উপর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে নাজিল হয় ইন্টারনেটের মূল্য। এক একটি ক্লাস করার জন্য যে পরিমাণ ডাটা প্রয়োজন সেই পরিমাণ ডাটা কেনার যে অর্থ দিতে হয় সেই অর্থ দেবার ক্ষমতা বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষার্থীর অবশ্যই নেই। তারপরেও লকডাউনে আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে চলছিল এই অনলাইন ক্লাস।
Advertisement
কিন্তু বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্রেক তখনই হয় যখন অন্যান্য খাত কে প্রণোদনা দিয়ে সেই সব খাতের গুরুত্বের কথা চিন্তা করে লকডাউনে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় এবং পরবর্তীতে সেই সব খাতের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে লকডাউন তুলে নিয়ে অফিস আদালত বাজার ঘাট সব উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ শুধু শিক্ষা খাতের বেলায় একের পর এক ছুটির ঘোষণা দিয়ে দায় সারতে থাকেন। এমনকি যখন সিনেমা হল ও বিনোদন কেন্দ্র উন্মুক্ত করার চিন্তা করা হয় তখন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর সেই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেয়া ছুটি বৃদ্ধির খড়গ ঝুলতে থাকে এবং কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় শিক্ষার্থীর করোনাকালিন নিরাপত্তার কথা।
স্বভাবতই এমন অর্বাচীন সুলভ সিদ্ধান্তের ফলে যে প্রশ্নগুলো মাথায় আসে তা হল পৃথিবীর কোন গবেষণা পত্রে এমনকি কি কোন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে করোনাভাইরাস শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই বিস্তার লাভ করে? তা না হলে বার বার করোনার বিস্তারের দোহাই দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ রাখা হচ্ছে? যে দেশে শপিং মল , গণপরিবহন , দূরপাল্লার পরিবহন, অফিস –আদালত, বাজার হাট সব কিছু খুলে দেয়া হয়েছে সেখানে আসলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে কিভাবে করোনা বিস্তার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?
দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি সুরাহা করা কঠিন তা হল একজন শিক্ষার্থী কিভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শুধু ঘরে অবস্থান করে করোনার থেকে নিরাপদ থাকবে যেখানে তার পিতা কিংবা মাতা অথবা পিতা মাতা উভয়কেই জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন বাইরে যেতে হচ্ছে। তারা হয়ত গণপরিবহনে গাদাগাদি করে কর্মস্থলে যাচ্ছেন এবং কর্মস্থলে কাজ শেষে আবার বাসায় ফিরে আসছেন। করোনার কারণে সেই ঘরে অবস্থান করা শিক্ষার্থীর গৃহে তার পিতা মাতার মাধ্যমে করোনাভাইরাস প্রবেশ করছে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? আর বিষয়টি যদি হয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাহলে তো স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে খুলে দিতে সমস্যা কোথায়? সমাজ জীবনে সব জায়গায় স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে এনে শিক্ষার্থীদেরকে কিভাবে করোনা থেকে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব? শিক্ষার্থীরা কি সমাজের বাইরে বসবাসরত কোন গোষ্ঠি?
এবার একটু ভাবার চেষ্টা করি যে এই শিক্ষার্থীরা আসলে এই আপদকালীন ব্যবস্থা তথা অনলাইনের ক্লাসের ফলে কি ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তাদের ব্যবহারিক কোন ক্লাস কিংবা পরীক্ষা কোনটি নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। একজন বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর জন্য ব্যবহারিক ক্লাস কত গুরুত্বপূর্ণ তা নতুন করে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।বলা হচ্ছে এই ব্যবহারিক ক্লাস পরে নেবার কথা। বন্ধের গ্যাঁড়াকলে জমে থাকা ব্যবহারিক ক্লাস এবং বন্ধ শেষ হবার পর যে নতুন সেমিস্টারের ব্যবহারিক ক্লাস মিলে যে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হবে সেই হ-য-ব-র-ল অবস্থায় শিক্ষার্থীরা আদতে যে কি শিখতে পারবে তা তো কেবল বিধাতাই জানেন!
Advertisement
এ তো গেল ব্যবহারিক ক্লাসের কথা, এবার আসি অনলাইনের ক্লাসের নামে যে ক্লাস করানো হয় সেই বিষয়ে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে শিক্ষার্থীর বাস সে দুর্বল মোবাইল নেটওয়ার্কের কারনে একটি অনলাইন ক্লাসের কতটুকু ই বা শুনতে পাচ্ছে? একজন শিক্ষার্থী যদি তার ক্লাসের লেকচার ঠিক মত শুনতেই না পারে তবে তবে সেই ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা কি? এরপর আশা যাক অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া প্রসঙ্গে। অনলাইনে নেয়া পরীক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ কিভাবে সম্ভব? শিক্ষক একটি প্রশ্ন অনলাইনে আপলোড করে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা সেই প্রশ্ন ডাউনলোড করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উত্তর লিখে শিক্ষকে ফেরত দিচ্ছেন। এখন সেই প্রশ্ন পেয়ে আসলে কি বই দেখে লেখা হয়েছে নাকি না দেখে? শিক্ষার্থী নিজে লিখেছে নাকি অন্যকারো সাহায্য নিয়েছে? অনলাইন পরীক্ষায় এই বিষয়গুলোর উত্তর জানা সম্ভব না তথা অনলাইনে নেয়া পরীক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। তাহলে স্বাভাবতই প্রশ্ন জাগে এই মানহীন পরীক্ষার মূল্য আসলে কতটুকু? নিঃসন্দেহে বলা যায় আপদকালীন ব্যবস্থা তথা অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা যত বেশি প্রলম্বিত হবে শিক্ষা ব্যবস্থা ততবেশি গভীর ক্ষত সৃষ্টি হবে।
সব শেষে বলতে চাই, শিক্ষা খাতের ক্ষতি হয়ত অন্যান্য খাতের মত নগদ মূল্য দিয়ে পরিমাপ সম্ভব নয় কিন্তু তারমানে এই মানে এই নয় যে এই খাতের গুরুত্ব কোন অংশে কম। বরং এই খাতের বিন্দু মাত্র চিড় ধরলে তা জাতির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে। জাতি হিসেবে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলব। তাই শিক্ষার্থীদের ক্ষতির কথা অনুধাবন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিৎ স্বাস্থ্যবিধি মেনে অন্যান্য খাতের ন্যায় শিক্ষাখাতেও স্বাভাবিক কার্যক্রম চালুর বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া।
লেখক : গবেষক।
এইচআর/জেআইএম