জাতীয়

অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য চট্টগ্রাম সরকারী সিটি কলেজের

করোনাভাইরাস কত কিছুই না বদলে দিয়েছে। মানুষের জীবনের গতিই বলতে গেলে পাল্টে দিয়েছে চোখে না দেখতে পাওয়া ক্ষুদ্র এই অণুজীবটি। অন্য অনেক কিছুর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদান কার্যক্রমেও ভিন্নতা এনে দিয়েছে করোনাভাইরাস। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সারাবিশ্বেই অনলাইনের মাধ্যমে নেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ক্লাস এবং পরীক্ষা। করোনার প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে শুরু হতে না হতেই গত মার্চে সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় সরকার। শুরুতে লকডাউনের কারণে সারাদেশই বলতে গেলে স্থবির হয়ে পড়েছিল। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে প্রযুক্তির সাহায্যে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে শুরু করে।

Advertisement

এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমি উদাহরণ স্থাপন করেছে চট্টগ্রাম সরকারী সিটি কলেজ। ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৬ হাজার। এত বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ ভাগকে অনলাইন ক্লাসের আওতায় নিয়ে আসা এবং তাদের পরীক্ষা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই কলেজটি।

অধ্যক্ষ অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদের সুদক্ষ পরিচালনায় গত ৬ থেকে ৭টি মাস নিরলসভাবে প্রায় ১২০জন শিক্ষক কলেজের শিক্ষার্থীদেরকে ডিজিটাল ক্লাসে সম্পৃক্ত করে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেয়ার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। মূলতঃ বিকল্প উপায়ে ডিজিটাল ফ্ল্যাটফর্মে শিক্ষাকার্যক্রম এগিয়ে নিতে গত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে অনলাইন ক্লাস চালু করে চট্টগ্রাম সরকারী সিটি কলেজ।

দেশের অন্য অনেক কলেজ যখন তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসে স্থাপিত স্টুডিওতে রেকর্ডকৃত ভিডিও ইউটিউব বা ফেসবুকে আপলোড দিয়ে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সেখানে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের শিক্ষকরা জুম এবং গুগল মিট-এর ফ্রি ভার্সন ব্যবহার করে লাইভ ক্লাসে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ইন্টারেকটিভ ক্লাস পরিচালনা করে আসছেন।

Advertisement

আবার লাইভ ক্লাস শেষে এর রেকর্ড করা ভিডিওগুলো কলেজের ফেসবুক গ্রুপে শেয়ার করা হচ্ছে। ফলে লাইভ ক্লাস মিস করা শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি চট্টগ্রাম শহর ও শহরের বাইরে অন্য কলেজের শিক্ষার্থীরাও এ ক্ষেত্রে বেশ উপকৃত হচ্ছে। প্রথমে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর জন্য অনলাইন ক্লাস চালু করা হলেও পরবর্তীতে কলেজে অধ্যয়নরত অনার্স ও মাস্টার্সের প্রায় ১৬,০০০ শিক্ষার্থীকে এই প্রক্রিয়ার আওতায় নিয়ে আসা হয়।

নিয়মিত অনলাইন ক্লাস পরিচালনার পাশাপাশি গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষাও অনলাইনে নেয়া হয়। কলেজটির একাদশ শ্রেণীতে মোট শিক্ষার্থী রয়েছেন ২১০০ জন। এর মধ্যে অনলাইন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রায় ৯৬ ভাগ শিক্ষার্থী।

চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম (বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি), বাঁশখালি এবং মহেষখালির মত দুর্গম ও অপেক্ষাকৃত অনুন্নত এলাকায় বসবাস করার ফলে প্রায় ৪ ভাগ অনলাইন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন অধ্যক্ষ অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ।

জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমাদের কলেজে পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাঁশখালি, কক্সবাজারের মহেষখালির মত দুর্গম এলাকার অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি হন। সরকারি কলেজ হওয়ার কারণে, আর্থিকভাবে অসচ্ছ্বল পরিবারের অনেক ছেলে-মেয়ে এখানে শিক্ষালাভের সুযোগ পায়। কিন্তু করোনার মধ্যে তারা তো প্রত্যন্ত গ্রামে বসে প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে অনলাইন পরীক্ষায় সাড়া দিতে পারেনি। এ কারণেই মূলতঃ কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী আমাদের এই অনলাইন কার্যক্রমের বাইরে থেকে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি, শতভাগ শিক্ষার্থী যেন অন্তত পাঠদান কার্যক্রমের বাইরে থেকে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে।’

Advertisement

কিভাবে বাদ পড়া শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস কিংবা পরীক্ষায় সম্পৃক্ত করা হবে? জানতে চাইলে অধ্যক্ষ অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ বলেন, ‘আমরা মূলতঃ নির্দিষ্ট শিক্ষককে দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাগ করে দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট ওই শিক্ষক হচ্ছেন সেই শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলর। আমি কমিটি গঠন করে দিয়েছি, কারা কারা পরীক্ষার বাইরে পড়ে গেছে তাদের খুঁজে বের করতে, তাদের সমস্যা শুনতে এবং তাদেরকে কিভাবে সম্পৃক্ত করা যায়, তার একটা সুপারিশমালা তৈরি করতে। প্রয়োজনে আমরা আরেকবার পরীক্ষা নেবো। তবুও, শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে চাই আমরা।’

চট্টগ্রাম সিটি কলেজ প্রথম থেকে এখনও পর্যন্ত জুম, গুগল মিট কিংবা গুগল ক্লাসরুমের ফ্রি ভার্সন ব্যবহার করে অনলাইন ক্লাসের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। লাইভ স্ট্রিমিং সফটওয়্যারগুলোর ফ্রি ভার্সনের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কিভাবে ১৬ হাজার শিক্ষার্থীকে এই কার্যক্রমের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে?

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই মূলতঃ এভাবে (ফ্রি সফটওয়্যার ব্যবহার করে) করে এসেছি। তবে সমস্যা যে হয়নি তা নয়। অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি আমরা। কলেজের ১২০ জন শিক্ষক। সবাইকে দায়িত্ব দিয়েছি। তারা তাদের সাবজেক্ট কিংবা গ্রুপ ভাগ করে করে ফ্রি সফটওয়্যার ভার্সন ব্যবহার করে ক্লাসের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়েছেন। পুরো কলেজের শিক্ষকরা এ কার্যক্রম পরিচালনায় দারুণ সহযোগিতা করেছেন। না হয় এতবড় কর্মযজ্ঞ পালন করা সম্ভব ছিল না।’

অধ্যক্ষ অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ ও উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সুদীপা দত্ত

অনার্স ও মাস্টার্সে অধ্যয়নরতদের আভ্যন্তরীন পরীক্ষাগুলোও কি অনলাইনে নেয়া হচ্ছে? কিংবা এই পরীক্ষাগুলো গ্রহণের বিষয়ে কি চিন্তা-ভাবনা রয়েছে সিটি কলেজের? জানতে চাইলে অধ্যক্ষ বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি। একাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো।’

দূরবর্তী ও অনুন্নত এলাকায় বসবাসকারী দরিদ্র শিক্ষার্থীদেরকে অনলাইন কার্যক্রমের আওতায় আনার জন্য একটি স্বমন্বিত পরিকল্পনা প্রনয়নের কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সুদীপা দত্ত। তিনি বলেন, ‘আমরা আশাই করিনি যে, অনলাইন ক্লাসে এতটা সাড়া পাবো। কারণ, আমাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক। এর মধ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনেক শিক্ষার্থীর বসবাস। তবুও যে সাড়া পেয়েছি তা অভাবনীয়।’

সামনে উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে আরও সহজে পৌঁছানোর চিন্তা রয়েছে বলেও জানান ড. সুদীপা দত্ত। তিনি বলেন, ‘আমরা এ নিয়ে কাজ করছি। গুগল ক্লাসরুমের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে হয়তো এটা সম্ভব। আমরা এ নিয়ে পরিকল্পনা করছি এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।’

উপাধ্যক্ষ ড. সুদীপা দত্ত সরকারের কাছেও একটি আহ্বান জানিয়েছেন। সেটা হচ্ছে, ‘অনলাইন ক্লাস এবং পরীক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রে বিশাল একটি খরচের ব্যাপার আছে। এখনও পর্যন্ত আমরা কলেজের ব্যবস্থাপনায় অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার কার্যক্রম চালাচ্ছি। যদি এ বিষয়ে প্রনোদনা থাকতো, তাহলে কাজগুলো আরও সহজ হয়ে যেতো।’ এ বিষয়ে প্রয়োজনে সরকারের কাছে আবেদন করা হবে বলেও জানান তিনি।

অনলাইন ক্লাস গ্রহণের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে কলেজের শিক্ষক পরিষদ সম্পাদক ও সহকারি অধ্যাপক (গণিত) আহমদ ছোবহান বলেন, ‘প্রথমদিকে কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগলেও ধীরে ধীরে কলেজের শিক্ষকগণ বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন।’ তিনি কার্যকর অনলাইন ক্লাসের স্বার্থে শিক্ষকদেরকে ‘ইন্টারনেট ভাতা’ ও ডিজিটাল ডিভাইস প্রদানের জন্য সরকারের কাছে দাবি জনান।

চট্টগ্রাম সিটি কলেজের অনলাইন ক্লাস পরিচালনা কমিটির উপদেষ্ঠা, পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবু মো: মেহেদী হাছানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এত বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর অনলাইন পরীক্ষা কিভাবে সফলভাবে সম্পন্ন করলেন?

জবাবে তিনি বলেন, ‘গুগলের ফ্রি সফটওয়্যার ব্যবহার করে। এগুলো বিনা পয়সার সফটওয়্যার। টাকা লাগেনি। তবে কিছু সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়েছি। প্রথমে আমরা এ নিয়ে একটা ভিডিও করেছি। সেটা দেখিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে পরিচিত করেছি। ডেমো পরীক্ষা নিয়ে তাদেরকে অভ্যস্ত করেছি। যে সব অনলাইন ক্লাস হয়েছে, সেগুলোতে মোটিভেশন করছি। এরপরই মূল পরীক্ষা নিয়েছি।’

মেহেদী হাছান জানিয়েছেন, সরকারী কলেজগুলোর নিজস্ব ফান্ড রয়েছে। তবে, অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষার জন্য চাইলেই খরচ করার সুযোগ নেই। সরকার যদি কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করে, তাহলে কলেজগুলোই নিজস্ব ফান্ড থেকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যায় করতে পারতো। একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, সরকার যদি টেলিটকের নেটওয়ার্ক শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়, তাহলে সেটা অনেক ভালো হবে।

চট্টগ্রাম সরকারী সিটি কলেজের অনলাইন পরীক্ষার টেকনিক্যাল বিষয়াধি নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করা ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন ও গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমরা কোন কাস্টোমাইজ সফটওয়্যার কিংবা বণিজ্যিক কোন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ছাড়াই গুগলের ফ্রি টুলসগুলোর কার্যকর স্বমন্বয় ঘটিয়ে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ স্যারের নির্দেশনায় একটি সফল অনলাইন পরীক্ষা সম্পন্ন করেছি। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য আমরা আলাদা প্রশ্নসেট ব্যবহার করে পরীক্ষা নিয়েছি।’

আইএইচএস/এমএস