চলে গেছেন আইয়ুব বাচ্চু। ভক্তদের প্রিয় ‘এবি বস’। আমার অভিভাবক, প্রিয়জন, প্রিয় মানুষ, আমার বস। তার মৃত্যুর পর থেকেই অদ্ভূত একটা সময় এসে গেল আমার জীবনে। ১৮ অক্টোবর ঘনিয়ে আসতেই অনেকে যোগাযোগ করেন, একটা লেখা দিন এবি বসকে নিয়ে। যেখানে থাকবে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ, অজানা কথাগুলো।
Advertisement
প্রস্তাব পেয়ে ভাবি, এমন দিন আসুক আমি তা কোনোদিন চাইনি যে বস নেই, আর আমাকে তার স্মৃতিকথা লিখতে হচ্ছে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, তার সঙ্গে প্রকৃতি ঘটায় অন্যরকম। আমি লিখছি বসের মৃত্যুর দিন থেকেই। বসকে নিয়ে কিছু কথা বলে কিছু নেই আমার কাছে। তাকে নিয়ে অনেক অনেক কথা বুকে জমে আছে। এগুলো বুকে নিয়েই হয়তো আমিও একদিন চলে যাবে বসের রুপালি গিটার ফেলে যাওয়া পৃথিবী থেকে। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ প্রায়ই আমাকে বলতো ‘এই যে একসাথে আমরা ঘুরছি, সুন্দর সময় কাটাচ্ছি- এই স্মৃতিগুলোই থাকবে। হয়তো কোনও সময় যোগাযোগ থাকবে না, দেখা হবে না, মিস করব একজন আরেকজনকে, দেখবে তখন এই সুন্দর স্মৃতিগুলো মনে করলে ভালো লাগবে।' কিন্তু আসলেই কি তাই? সব স্মৃতিই কি ভালো লাগায় ডুবিয়ে দেয়?
আসলে জীবনে চলার পথে কিছু মানুষের সাথে সবারই দেখা হয়ে যায়। সেই মানুষগুলো এমন অদ্ভুত একটা ছাপ রেখে যায় যে চাইলেই তাদের ভুলে যাওয়া যায় না। তারা এতটাই অদ্ভুত হয় যে জীবনের সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে হুট করে চলে যায় কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই! আমার এই ছোট্ট জীবনে সেরকমই একটা মানুষের সাথে দেখা হয়েছিল। অদ্ভুত একটা মানুষ। তাকে ভালোবাসতো অগণিত মানুষ। ভুল বললাম 'ভালোবাসতো' না তাঁকে এখনও ভালোবাসে অগণিত মানুষ, বাসবেও চিরকাল।
নিজে যেমন কাঙাল ছিল ভালোবাসার জন্য, ঠিক তেমনি যাদেরকে তিনি আপন ভেবে কাছে টেনে নিতেন তাদের জন্যও তার ভালোবাসা ছিল অসীম। তিনি আইয়ুব বাচ্চু, 'বস'। আমার 'বস', আমাদের 'বস', কোটি মানুষের ভালোবাসার 'বস'।
Advertisement
অদ্ভুত এই মানুষটার প্রতি ভালোবাসা, ভালোলাগার সবটারই শুরু গান দিয়ে। আমাদের স্কুল-কলেজের লাইফে ব্যান্ড শব্দটা ছিল এক ঘোর লাগা উন্মাদনার নাম। এই উন্মাদনার নেশায় আব্বা-আম্মার হাতে মার খেয়েছি মেলা। কিন্তু তাতে উন্মাদনা কমেনি কখনও, বরং বেড়েছে তা সবসময়। এখনকার মতো চাইলেই ইউটিউব বা অনলাইনে সার্চ করে গান শোনার সুযোগ আমাদের ছিল না তখন। বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে ৩৫ টাকা দিয়ে একটা ক্যাসেট কিনে (অনেক সময় ভাগেও কেনা হতো সেই ক্যাসেট), তা বাসায় এনে আব্বা-আম্মার হাতে - পায়ে ধরে হয়তো ১ ঘন্টার অনুমতি মিলতো ক্যাসেট প্লেয়ারে তা শোনার। সেই ১ ঘন্টা ছিল প্রথম প্রেমে পড়ে প্রথম চিঠি পাবার অনুভূতির মতো! সে আবেগ, সে ভালোলাগা বোঝাতে পারবো না এই ফেসবুক বা ইউটিউবের যুগে।
১৯৯২ সালের একটা কথা মনে পড়ে। পল্টন সুপার মার্কেটের দোতালায় জাহাঙ্গীর ইলেক্ট্রনিক্স এ এক বিকেলে গিয়েছিলাম এমনি ঘুরতে। পুরো পল্টন এলাকায় ওই একটাই তখন অডিও ক্যাসেটের দোকান। যেহেতু সবসময় ক্যাসেট কেনার মতো টাকা থাকতো না সেহেতু বিকেলে ওই দোকানের আশেপাশে ঘুরতাম ফ্রি গান শোনার লোভে। যেহেতু অডিও ক্যাসেটের দোকান প্রায় সারাক্ষণই হিন্দি বা বাংলা গান বাজতই। মাগরিবের আজান পর্যন্ত সেই ফ্রি গান শুনে ফিরে আসতাম বাসায়। তো সেরকমই এক বিকেলে গিয়েছিলাম সেই দোকানে। দোতালার সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময়ই কানে ভেসে আসলো একটা গান। গানটা হলো 'ঢাকার সন্ধ্যা'। এই গানের শুরুতে একটা হাসি ছিল-সেটা শুনলেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেত। খোঁজ নিয়ে জানলাম এটা এল.আর.বি নামের একটা নতুন ব্যান্ডের গান। সেই নতুন ব্যান্ডের প্রথম ডাবল অ্যালবামের সবগুলো গানই এক নতুন নেশার জন্ম দিয়েছিল তখন। সেই যে ভালোবাসলাম গানের মানুষটাকে তা বুকের ভেতর বহমান এখনও।
আইয়ুব বাচ্চু- এই নামটির সাথে জড়িয়ে আছে কোটি মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। এই বিশাল মাপের মানুষটির সাথে টানা ২০টি বছর মেশার, তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ভক্ততো তার ছিলামই আগে থেকে কিন্তু সাংবাদিকতা পেশায় আসার পর কর্মসূত্রেই পরিচয়ের শুরু। জানিনা কোনও এক অজানা কারণে 'বস' আমাকে পরিচয়ের প্রথমদিন থেকেই বেশ পছন্দ করেছিলেন। সময়ের সাথে সাথে সেই পছন্দটা পেশাগত সীমারেখার বাইরে যেয়ে হয়ে উঠেছিল পুরোপুরিই আত্মিক। আসলে সেই সম্পর্কের নামটা যে কি তাই বলা কঠিন আমার জন্য।
সময় যতো গড়িয়েছে আমার প্রতি বসের ভালোবাসা, বসের প্রতি আমার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা চক্রাকারে বেড়েই চলেছে। বস কোনও এক কারণে আমাকে শুরু থেকেই খুব আদর করতেন। আমি আজও জানিনা সেই কারণটা কি। আমার এই ছোট্ট জীবনে কি নাই তার সাথে? রাগ,অভিমান, সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা কত কত স্মৃতি। প্রায় ২০টা বছর এই মানুষটা আমাকে আগলে রেখেছিলেন সন্তানের মমতায়, ছোট ভাইয়ের ভালোবাসায়। শেষের দিকে একটু কথা কম হতো বসের সাথে। তবে দেখা হতো নানা অনুষ্ঠানে। দেখা হলেই বা কথা হলেই প্রথমেই বলতেন 'কি রে ভুলেই তো গেলি?' আমি বলতাম 'কি যে বলেন বস? আপনাকে ভুলবো আমি?'
Advertisement
বস দেখেন আমি আপনাকে ভুলি নাই। আপনাকে প্রতিদিনই মনে করি কোনো না কোনো উছিলায়। আপনাকে হারানোর হাহাকার, ব্যথা, কষ্ট কোনোটাইতো কমেছে না। কোনোদিন কমবে না বস। এখনও মন খারাপ হলে আপনার গান শুনি, মন ভালো থাকলেও আপনার গান শুনি। বন্ধু, সহকর্মীদের আড্ডায় অবধারিতভাবে আপনার গল্প উঠে আসে। মুহূর্তেই তখন দেখি খানিক আগের হাসিখুশি মানুষগুলোর মুখে বিষণ্ণতা, কষ্টর ছাপ। চোখের কোণে জলের আভাস।
আমি, আমরা আপনাকে ভালোবেসে চলেছি। আপনিও ওপার থেকে ভালোবাসা দিয়েন বস।
লেখক : মঈনুল হক রোজসিনিয়র বিনোদন সাংবাদিক
এলএ/পিআর