বিশেষ প্রতিবেদন

মেশিনম্যান সালামের পারিবারিক চক্রের সম্পত্তির খোঁজে সিআইডি

মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের মাস্টারমাইন্ড স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর মেশিনম্যান আব্দুস সালাম খান। তারই খালাতো ভাই জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু নিজেদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে অর্থাৎ পারিবারিক চক্রের মাধ্যমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতেন ফাঁস করা প্রশ্ন। সম্প্রতি গ্রেফতারের পর মেশিনম্যান সালামকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। প্রশ্নফাঁসে অর্জিত অর্থ-সম্পত্তি সম্পর্কে মুখ না খুললেও বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন সালাম। সেসব তথ্য ধরেই তদন্তে এগোচ্ছেন কর্মকর্তারা।

Advertisement

মেডিকেল-ডেন্টাল পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় গত ২০ জুলাই জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু, পারভেজ খান, জাকির হোসেন দিপু ও সামিউল জাফর সিটুকে গ্রেফতার করে সিআইডির সাইবার পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ৫-৬ জন চিকিৎসক ও দুটি কোচিং সেন্টারের মালিকের প্রশ্নফাঁসে জড়িত থাকার তথ্য উঠে আসে। তবে রিমান্ডে মেশিনম্যান সালাম আরও তিনজন চিকিৎসকের ব্যাপারে তথ্য দিয়েছেন। অর্থাৎ ৮-৯ জন চিকিৎসকের তথ্য-প্রমাণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। পাশাপাশি অন্য জড়িতদেরও গ্রেফতারে অভিযান চলছে।

এ ব্যাপারে সিআইডির সাইবার পুলিশের বিশেষ এসপি এস এম আশরাফুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন, যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। স্বচ্ছ তদন্ত ও উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা এই প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের মূলোৎপাটন করব।’

স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর ছাপাখানাতেই মেডিকেল-ডেন্টালের প্রশ্নফাঁস

Advertisement

স্বাস্থ্য অধিফতর সূত্রে জানা গেছে, মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদফতরে স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর ছাপাখানায় বছরজুড়েই স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ছাপার কাজ চলে। পোস্টার, ব্যানার, বুকলেট থেকে শুরু করে এমবিবিএস ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ছাপা হয় এখানে।

সর্বোচ্চ সতর্কতা আর গোপনীয়তার সঙ্গে প্রশ্নপত্র ছাপার কাজ হয় বলা হলেও কীভাবে মেডিকেল-ডেন্টালে ভর্তির প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো সময় সদুত্তর দিতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বরং বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, প্রশ্নফাঁস হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ এমন সুযোগই নেই।

এক সময় এই ছাপাখানার দায়িত্বে ছিলেন সালাম ও শরীফ নামে আরও একজন। একটি মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর বরখাস্ত হন সালাম। এর মাঝে মোস্তফা কামাল নামে একজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

এ ব্যাপারে এর আগে স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর প্রেস ম্যানেজার ফায়েজুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, বরখাস্ত হওয়া সালামকে হঠাৎ করে পুনরায় ওই মেশিনের দায়িত্ব দেয়া হয়, বড় লেভেলের ছত্রছায়ায়। উচ্চপর্যায়ের লোক এসে রাত ২টার সময় ওই মেশিনে তাকে বসিয়ে দিয়ে যায়। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ বারবার উঠলেও সালামের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং মেশিনম্যান সালামের সঙ্গে আগে থেকে প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের অন্যতম হোতা জসিমের যোগাযোগ ছিল।

Advertisement

কে এই সালাম?

আব্দুস সালাম খানের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার তালেবপুর ইউনিয়নের কাশেমপুর গ্রামে। ১৯৮৮ সালে তিনি মেশিনম্যান হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদফতরে চাকরি শুরু করেন। স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোর একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অদৃশ্য শক্তি বলতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার বরখাস্ত হওয়া হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেনের দাপটে চলতেন সালাম। যে কারণে হঠাৎ করে কামালকে সরিয়ে ফের বসিয়ে দেয়া হয় সালামকে। সম্প্রতি আদালতের নির্দেশে দেশ থেকে পলাতক এই আবজাল ও তার স্ত্রীর সম্পদ জব্দ (ফ্রিজ) করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সিআইডি জানায়, সরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের মূলহোতা মেশিনম্যান সালামকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারের চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয় সিআইডি। সর্বশেষ গত ৫ অক্টোবর ছদ্মবেশ ধরে রাজধানীর বনশ্রীর জি ব্লক এলাকা থেকে আবদুস সালামকে গ্রেফতার করে সাইবার পুলিশ।

গ্রেফতারের পর এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি'র সাইবার পুলিশের বিশেষ এসপি এস এম আশরাফুল আলম বলেন, ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে ঢাবি কর্তৃপক্ষের দায়ের করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে সরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসচক্রের সন্ধান পায় সাইবার পুলিশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত এস এম সানোয়ার হোসেনকে গ্রেফতারের পর সরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে।

তিনি বলেন, সানোয়ারের তথ্যের সূত্র ধরে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁসের হোতা জসিম উদ্দিন ভূইয়া, জাকির হোসেন দিপু ও পারভেজ খানকে।

অনুসন্ধানে জসিমের মোট ৩৮টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২১ কোটি ২৭ লাখ টাকার সন্ধান পায় সিআইডি। একইভাবে তার স্ত্রী শারমিন আরা জেসমিন ওরফে শিল্পীর ১৪টি অ্যাকাউন্টে জমা টাকার পরিমাণ দেখা যায় তিন কোটি ৭৮ লাখ। এই টাকার লেনদেন বেশি হয়েছে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার সময় অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে। গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর মেশিনম্যান আব্দুস সালামের নাম উঠে আসে।

সালাম-জসিমের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে পারিবারিক প্রশ্নফাঁস চক্র

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, মেশিনম্যান আব্দুস সালাম খান ছাপাখানা থেকে প্রশ্নফাঁস করতেন। এরপর তার খালাতো ভাই মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের অন্যতম হোতা জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু সারাদেশে তা ছড়িয়ে দিতেন। সারাদেশে প্রায় অর্ধশত সদস্যের একটি চক্র নিয়ন্ত্রণ করতেন জসিমের পারিবারিক ঘনিষ্ঠজনরা। এদের মধ্যে রয়েছেন ভাতিজা পারভেজ খান, বোনজামাই জাকির হোসেন দিপু, ভায়রা সামিউল জাফর সিটু, দুলাভাই আলমগীর হোসেন, স্ত্রী শারমিন শিল্পী ও ভাগ্নে রবিন।

এর বাইরে সারাদেশের চিকিৎসক ও কোচিং সেন্টারের মালিকরাও এর সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে দিনাজপুরের সাজ্জাদ ও আলমাস শেখ, নারায়ণগঞ্জের কাউছার, যশোরের রওশন হিমু, ডা. সালেহীন শোভন ও ডা. ময়েজ উদ্দিনসহ কিছু চিকিৎসকের নামও জেনেছে সিআইডি

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডির সাইবার পুলিশের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, সালামের ব্যাংক হিসাবের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চাওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, সালামের নেশা ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি কেনা। সেসব ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার অফিসে চিঠি দেয়া হয়েছে। সালাম ও তার পরিবার এবং প্রশ্নফাঁস চক্রের কার কী পরিমাণ জমি, কবে নথিভুক্ত হয়েছে— সেসব বের করা হবে। অনুসন্ধান কার্যক্রম সমাপ্ত হলে প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হবে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় জড়িত ৭-৮ জন চিকিৎসকের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। বেশ অগ্রগতিও হয়েছে। পাশাপাশি জালিয়াতিতে ভর্তি ও পাস করা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হবে।

জেইউ/এইচএ/এমএআর/পিআর