পিয়াস সরকার
Advertisement
‘সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা যাবে না, একা একা কোথাও যাওয়া যাবে না, যাচ্ছে তাই পোশাক পরা যাবে না। বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যাওয়া যাবে না। কারণ এসব কোথাও আমি নিরাপদ নই। তারপর একদিন এলো আমি স্বামীর সাথে নিরাপদ নই, দিনের আলোতেও নিরাপদ নই, আমি বাইরে নিরাপদ নই। এখন জানলাম আমি আমার ঘরেও নিরাপদ নই। আমি মায়ের আঁচল তলেও নিরাপদ নই। আমার বাবা, আমার ভাই, আমার স্বামী আমার সন্তান আমার সমাজ কেউ আজ আমার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। আমার নিরাপত্তা কোথায়? এমন জন্ম তো আমরা চাই নি।’ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর দেয়া স্ট্যাটাস এটি।
তার সঙ্গে প্রশ্ন তুলতেই পারি নারীরা কোথায় নিরাপদ? নোয়াখালীর ভিডিওটি দেখে আমাদের যেমন গা শিউরে উঠেছে। কিন্তু ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে বলেই কিন্তু আমরা বিষয়টি জানতে পেরেছি। যদি ভিডিওটি না ছড়াতো? কী হতো? আমরা জানতেও পারতাম না এরকম লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে আমাদের চারপাশে। এরকম ঘটনা নিশ্চয়ই অহরহ ঘটছে।
সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়েও রেহাই পাননি গৃহবধূ। এরপর মায়েরাও হয়ত মুখ লুকাবেন যারা বলতেন, বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে যেও। ধর্ষকরা স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দী দিয়েছে। আবার এরাই দম্ভোক্তি করেছে আদালতে দাঁড়িয়ে। এই সাহস তারা কোথায় পায়? যদিও ইতিবাচক দিক হচ্ছে এই ধর্ষকদের পাশে দাঁড়াননি কোন আইনজীবী। এরপরও কিন্তু থেমে নেই ধর্ষণ। প্রতিদিনই খবরের পাতায় উঠে আসছে নির্মম নির্যাতনের ঘটনা।
Advertisement
আরেক শিক্ষার্থীর স্ট্যাটাস, আমি কি নেক্সট? আমি ধর্ষিত হলে প্রতিবাদ করিয়েন প্লিজ। প্রতিবাদ না করলেও আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা জানতেও পারবে না কেউ। হয়ত আমাকেই প্রশ্ন তুলবে- ওর পোশাক ঠিক ছিলো না।
আরেক শিক্ষার্থী স্ট্যাটাস দিয়েছেন, এমন কোন মেয়ে কী আছেন, যে মলেস্টের শিকার হননি? বেশ কয়েকজন নারীর গল্প বলি। এক মেয়ে জানালেন, কলেজে থাকা অবস্থায় রাতে বেশ কয়েকবার হোস্টেলের পাহাড়াদার তাদের দেখিয়ে হস্থমৈথুন করতো। এই নিয়ে বিচার চাওয়ায় উল্টো হয়রানির শিকার হয়েছেন। আরেক ছাত্রীকে বাবার বয়সী পুলিশের এক সদস্য নিয়মিত বিরক্ত করে আসছেন। আরেক নারী বললেন, বাসের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় তার বুকে হাত দিয়ে দৌড়ে পালায় একজন। একজন প্রবীণ শিক্ষক রাত কাটানোর জন্য প্রস্তাব দেন। এই নিয়ে ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর বিরতির গল্পও শোনান তিনি। আমার ধারণা অধিকাংশ নারীই এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছেন, যাচ্ছেন।
এসবের বাইরে মহামারি আকার ধারণ করা ধর্ষণতো আছেই। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে চলতি বছরে জানুয়ারি-আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন এক হাজার ২০৪ নারী। যেখানে ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণ, ২০১৮ সালে ৭৩২ জন এবং ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ নারী। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, ১লা জানুয়ারি থেকে ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার প্রায় দুই হাজার ৪৫৯ শিশু। যেখানে মার্চ থেকে ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত এই সংখ্যা প্রায় এক হাজার ৯০২ জন। আর ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে দুই হাজার ২৬ জন। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে প্রথম ছয় মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনে মামলা হয়েছে এক হাজার ৮০টি। যেখানে ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে মামলা হয় এক হাজার ১৯টি।
সাভারে ২০১৯ সালে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এক নববধু। ধর্ষণের পর চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তখন তার চোখে তাকানোর সাহস হয়নি আমার। কয়েকবার চোখ পড়েছিলো দেখেছিলাম কী নির্মমতা। তিনি জানিয়েছিলেন, ধর্ষণের পর তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টাও করেছিলো ধর্ষকরা। আরেক ধর্ষিতা নারী নির্যাতনের ছয় বছর পর বলেছিলেন, আজো ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। রাতে গা ঘেমে যায়। ভয়াল স্বপ্ন দেখি। ধর্ষণের ঘটনার পর এলাকায় যেনো ‘শো পিচে’ পরিণত হয়েছিলাম। বাইরে যেতে পারতাম না। সবাই কেমন চোখে তাকিয়ে থাকতো। ছোট ভাই একদিন এসে কান্নাকাটি করছিলো। তাকে নাকি সবাই অশ্লীল কথা শোনায়। এরপর বাধ্য হয়ে ঢাকায় চলে আসি। শেষ চার বছরে বাড়ি যাইনি। আর কোনদিন যেতে পারব কিনা জানিনা। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি নির্যাতনের শিকার হয়ে এলাকাছাড়া। তারা এখনও এলাকার প্রভাবশালী।
Advertisement
ধানমণ্ডি লেকে এক ব্যক্তি চা বিক্রি করেন। সেখানেই তার বাস। বয়স আনুমানিক ৪০। তার সঙ্গে কথায় কথায় একদিন জানতে পারি, তিনি ধর্ষণের দায়ে এলাকা ছাড়া হয়েছেন প্রায় ১০ বছর আগে। তার মেয়ের সঙ্গে খেলতে আসা বান্ধবীকে ধর্ষণ করে। এই ঘটনার পরে এলাকাছাড়া হতে বাধ্য হয় সে। ছেলেমেয়েরাও যোগাযোগ রাখেনি। কয়েক মিনিটের আনন্দ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে।
দেশে একটা সময় এসিড সন্ত্রাস চরম আকার ধারণ করেছিলো। এরপর এসিড নিক্ষেপের সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করা হয় মৃত্যুদণ্ড। এরপর কিন্তু এসিড সন্ত্রাস শূন্যের কোঠায় নেমে না আসলেও উল্লেখযোগ্য হারে কিন্তু কমে এসেছে। এসিড সন্ত্রাসের মতো ধর্ষণের শাস্তিও মৃত্যদণ্ড করবার দাড়প্রান্তে আমরা। আমার বিশ্বাস দেশে আলোচিত কয়েকটি ধর্ষণকাণ্ডের বিচার হলেও কমে যাবে ধর্ষণ। একটু স্বস্তিতে থাকুক আমার আপনার মা, বোন, কন্যা, স্ত্রী, আপনজনরা। তবে আন্দোলনকারীরা বলছেন এই আইনের ‘মিস ইউজ’র সুযোগ আছে। এসব কিন্তু উড়িয়ে বিচার হোক নির্যাতিতার। ধর্ষকদের চোখে তৈরি হোক ভীতি। হকে হবে বিচার। বিচার না হয়ে শুধুই যদি আইন থাকে তা হবে মূল্যহীন। আর যেন কোন বাবাকে নির্যাতিতা মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে লাফ দিতে না হয়। গুগল সার্চে কিংবা পত্রিকার পাতায় উঠে যাক ধর্ষণ শব্দটি।
‘বিচারহীনতা’র পাশাপাশি যৌন শিক্ষাতেও জোর দেয়া প্রয়োজন। সঠিক শিক্ষার অভাবেও বাড়ছে ধর্ষণ। যৌন চাহিদা সকলের আছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, ধর্ষণের মাধ্যমে মেলে না প্রশান্তি। এতে শুধুই জোর প্রদর্শন কিংবা শক্তিশালী তা প্রমাণিত হয়।লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/পিআর