ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে অধ্যাদেশ হওয়ার একদিন পর ধর্ষণ প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণসহ এ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) ৭০তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপনী ও সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে শেখ হাসিনা, সমসাময়িককালে সামাজিক এই ব্যাধির প্রকোপ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইদানীং ধর্ষণটা ব্যাপকভাবে হচ্ছে এবং প্রচারও হচ্ছে। এটার যত বেশি প্রচার হয়, প্রাদুর্ভাবটাও তত বাড়ে।’
Advertisement
প্রধানমন্ত্রীর এ কথাটি ঠিক যে, আগের চেয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক সক্রিয়তায়, নারীদের সচেতনতায় ধর্ষণের রিপোর্ট ও মামলা বেশি হচ্ছে। কিন্তু ধর্ষণ যে বাড়ছে, এটি যে এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে সে নিয়ে কারও দ্বিমত আছে বলে মনে করছি না।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নতুন সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তা হলো- ‘মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে’। ধর্ষণের শিকার যে কারও বিচার পাওয়ার জন্য পুলিশি আচরণ, সমাজের আচরণ, আধিপত্যবাদীদের আচরণ, আইনজীবীদের আচরণের বাইরে বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, প্রসিকিউশনের অদক্ষতা ও আন্তরিকতার অভাব, এভিডেন্স আইনের প্রতিবন্ধকতাও বড় ভূমিকা রাখছে।
প্রধানমন্ত্রী যখন প্রশাসনকে কঠোর হতে বলেন, যখন তার সক্রিয় উদ্যোগেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়, তখন তাকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটিতে পুলিশের আচরণ যে বড় ভূমিকা রাখে সেটি নিয়ে ভাবনাটা সব আলোচনায় আসা প্রয়োজন। ফেনীর নুসরাত হত্যার ঘটনা আমরা জানি। মাদরাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গিয়ে পুলিশের কাছে গিয়ে ওসি মোয়াজ্জেম কর্তৃক নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তিনি।
Advertisement
তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, ধর্ষণের শিকার নারী এই সমাজে যে মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়, তার উৎস কোথায়? অবশ্যই প্রথমে আসবে সমাজ এবং পরিবারের কথা। কিন্তু সমাজের সেসব প্রতিষ্ঠান, যাদের দায়িত্ব থাকে কাজ করার তারা এ ধরনের যন্ত্রণার মধ্যে থাকা ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির জন্য কী করে? ধর্ষণের শিকার নারী যখন থানায় অভিযোগ জানাতে যায় তখন পুলিশ কী করে? নারী ধর্ষণ নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও মাদরাসায় শিশু-কিশোররা যে বলাৎকারের শিকার হয় তাদের ব্যাপারে কতটা তৎপর হয়? সেই আলোচনা কি কোথাও হয়?
বারবার থানায় হাজিরা দেয়া, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করতে নতুন করে যৌন হয়রানির মুখে পড়া, পুলিশের হাজার রকমের অশ্লীল প্রশ্নের জবাব দেয়া, আর শুনানির কক্ষে আরও কয়েক দফা প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত নারী আসলে নতুন করে প্রকাশ্যে ধর্ষণের শিকার হন। এই যে ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি সমাজ ও তার প্রতিষ্ঠানসমূহ এমন আচরণ করে, যা প্রকারান্তরে ধর্ষণের যন্ত্রণা, গ্লানি ও অবসাদকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় তার সংস্কার কী হবে সে নিয়ে আলোচনা একেবারে নেই। ধর্ষণের শিকার নারীর জন্য প্রক্রিয়াগত এই ধর্ষণ যে কাউকে কাউকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয় সে নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা কোথাও কোথাও ছোটখাট গবেষণা করলেও এই আত্মবিনাশী তৎপরতা নিয়ে কোনো আলোচনা সংসদ, বিচার বিভাগ বা সমাজে নেই।
পুরো প্রক্রিয়ায় ভিকটিম ব্লেমিং বা ধর্ষণের শিকার নারীকেই দোষারোপ করার সংস্কৃতি আছে সুশীলদের কারও কারও মাঝেও। ধর্ষণ একমাত্র অপরাধ যেখানে ভিকটিমকেই তার অপরাধ প্রমাণ করতে হয় এবং তার পোশাক ও চালচলন নিয়ে শুধু প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠী নয়, পুলিশ বা আইনজীবী এমনকী রাজনীতিকরাও প্রশ্ন তুলতে পারেন। নারীর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে আলোচনা হয়, একাকী বা অসময়ে কেন বের হলো সেই আলোচনা হয় এবং এগুলো নিয়ে ভয়ংকর রকম কটাক্ষ হয় নাগরিক সমাজেও, যেমনটা করেছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুর। ধর্ষণের বিচার চাওয়া নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে কার্যত তিনি ধর্ষকদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন।
আর এভাবেই ধর্ষণের শিকার নারীর মর্যাদা ও সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়। পুলিশের মনস্তত্বে থাকে যে, ধর্ষণকারী দুর্বৃত্তের সাথে ধর্ষণের শিকার নারীর আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল, যেমনটা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন নুর। কোনো কোনো গণমাধ্যমও এই সত্য উপস্থিত করতে চায় বা ভিকটিমকে পতিতা বানাতে চায়। সমাজ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিকটিমের পরিবারও অপরাধীকে দমনের চেয়ে অপরাধের শিকার নারীর দোষ ধরার চেষ্টা করে।
Advertisement
সমস্যাটা এখানেই। কখনও কখনও কোনো কোনো গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় কেউ ধর্ষণের শিকার নারীর পরিচয় প্রকাশ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অথচ এদের সামান্য চেষ্টাও থাকে না ধর্ষকের পরিচয় প্রকাশে। আর পুলিশি ও আইনি জেরার কথাতো বললামই। নানা রকম জেরায় এবং আদালতে উপর্যুপরি জিজ্ঞাসাবাদ ও সাক্ষ্যদানের প্রক্রিয়ায় বারবার সেই ধর্ষণের যন্ত্রণা ও গ্লানিই ফিরে ফিরে আসে নারীর মনে।
ধর্ষণের শিকার নারীর মনস্তত্ব কেউ বুঝতে পারে না। মনের ক্ষত নিরাময়ের কোনো প্রচেষ্টা নেই কোথাও বরং ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরাতে তৎপর সবাই। মৃত্যুদণ্ডের বিধান হয়েছে, কিন্তু পুলিশ, আদালত, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, এমনকী গণমাধ্যমকে শোধরাবে কে? আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম? সেখানেও একটি চক্র ধর্ষণকাণ্ডের কাটা-ছেঁড়া করতে তৎপর থাকে নারীর চরিত্র আরও কতটা বেশি করে হনন করা যায় তা নিয়ে। এটি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের আরেক রূপ, সমাজের দ্বারা আরেক ধর্ষণ। মৃত্যুদণ্ড কাউকে কাউকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেবে, কিন্তু এমন প্রক্রিয়াগত ও সামাজিক ধর্ষণের প্রতিকার হবে কী করে?
এইচআর/বিএ/পিআর