মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত ভাসানচরের অস্থায়ী আবাসস্থল পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েছে। মৌলিক সুবিধা নিয়ে এখানে প্রায় লাখ খানেক রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হবে। প্রকৃতির অকৃত্রিম দান জল ও সবুজ গাছগাছালি বেষ্টিত নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার আওতাধীন দ্বীপটি এখন পরিকল্পিত বাসস্থানের বাস্তব উদাহরণ। যা দৃষ্টিনন্দনও বটে। এখানে কাজের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের বিনোদনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। যাতে সেখানে তারা হতাশ না হয়।
Advertisement
সরেজমিনে ঘুরে দেখে গেছে, ভাসানচরে নামার পরপরই সমুদ্রের কলকল ধ্বনি যেন সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। জেটি থেকে কিছুক্ষণ সামনের দিকে হাঁটলেই চোখে পড়ে ভিভিআইপিদের জন্য নির্মিত দৃষ্টিনন্দন আধুনিক বাসস্থান। সঠিক পথের সন্ধান দিতে সদ্য নির্মিত সুউচ্চ লাইট হাউজ যেন সদা জাগ্রত। এছাড়াও বৃহৎ কর্মকাণ্ডের নানা নমুনা সর্বত্র।
প্রায় ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকায় নির্মিত রোহিঙ্গাদের জন্য এই অস্থায়ী আবাসস্থল এখন কর্মমুখর। দ্বীপটি বাসস্থানের উপযোগী করা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বনায়ন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আশ্রয়ণ-৩ এর প্রকল্প পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অস্থায়ী এই বাসস্থান নির্মাণ করা হয়েছে। তাদেরকে যতদিন না নিজ দেশে ফিরেয়ে নেয়া হবে, ততদিন তারা এখানেই থাকবেন। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাইক্লোনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে রামগতি, নোয়াখালীতে ‘গুচ্ছগ্রাম’-এর সর্বপ্রথম ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন। পরবর্তীতে একই ধারণাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই গুচ্ছগ্রামের ধারণা থেকেই রোহিঙ্গাদের জন্য এই আশ্রয়ণ। তারা ফিরে গেলে বাংলাদেশের ভূমিহীন দুস্থ মানুষদের থাকার জন্য দ্বীপটি ব্যবহার করা হবে।’
Advertisement
সরেজমিন ঘুরে দেখে গেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য আধুনিক বাসস্থান ছাড়াও বেসামরিক প্রশাসনের প্রশাসনিক ও আবাসিক ভবন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভবন, মসজিদ, স্কুল হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ভবন, হাসপাতাল, ক্লিনিক, খেলার মাঠ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মহিষ, ভেড়া, হাঁস, কবুতর, পালন করা হচ্ছে সেখানে। আবাদ করা হচ্ছে- বিভিন্ন শাক-সবজির। পরীক্ষামূলকভাবে ধানচাষও করা হচ্ছে এবং এর ফলনও ভালো বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
এর মাধ্যমে আনুমানিক ১৩ হাজার একর লো লায়িং ভূমির (Low Laying Area) ৬ হাজার ৪২৭ একর বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য হলো। এর মধ্যে এক হাজার ৭০২ একর জমির চারপাশে বাঁধ নির্মাণ করে তার অভ্যন্তরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনার কাজে ৪৩২ একর এবং ভবিষ্যতে সম্প্রসারণ ও বনায়নের কাজে এক হাজার ৯১৮ একর এলাকা ফাঁকা রাখা হয়েছে। ৩৫২ একর জমি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ফরোয়ার্ড বেস তৈরির জন্য নির্ধারিত রাখা হয়েছে।
প্রকল্পটি মূলত ক্লাস্টার হাউজ, শেল্টার স্টেশন বা গুচ্ছগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউজ ও শেল্টার স্টেশন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মিত ভবনসমূহ ভূমি থেকে ৪ ফুট উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউজে ১২টি ঘর, প্রতিটি ঘরে ১৬টি করে রুম রয়েছে এবং একটি ৪ তলা বিশিষ্ট কম্পোজিট স্ট্রাকচারের (স্টিল) শেল্টার স্টেশন রয়েছে। মোট ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ঘরের সংখ্যা এক হাজার ৪৪০টি এবং ১২০টি শেল্টার স্টেশন নিয়ে গুচ্ছগ্রামটি গঠিত।
প্রকল্পটিতে যাতে এক লাখ এক হাজার ৩৬০ জন শরণার্থী বসবাস করতে পারেন সেই ব্যবস্থার আলোকে গুচ্ছগ্রামসমূহ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি গৃহে, প্রতি পরিবারের ৪ জন করে মোট ১৬টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। এছাড়াও প্রতিটি ক্লাস্টারে জন্য দুযোর্গময় পরিস্থিতিতে আশ্রয় নেয়ার জন্য তৈরিকৃত শেল্টার স্টেশনে স্বাভাবিক সময়ে ২৩টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। এই হিসাবে ক্লাস্টারের ১২টি হাউজে মোট ৭৬৮ জন এবং একটি শেল্টার স্টেশনে মোট ৯২ জনসহ সর্বমোট ৮৬০ জন সদস্য বসবাস করতে পারবেন। প্রতিটি হাউজের এক প্রান্তে বসবাসকারী পরিবারসমূহের নারী-পুরুষদের জন্য আলাদা গোসলখানা ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং প্রান্তে রান্নাঘরও রয়েছে।
Advertisement
১২০টি শেল্টারে দুর্যোগকালে প্রতিটিতে এক হাজার মানুষ এবং এর নিচতলায় ২০০ গবাদি পশু আশ্রয় নিতে পারবে। এই শেল্টার স্টেশনগুলো স্টিল ও কংক্রিটের কম্পোজিট স্ট্রাকচারে তৈরি, যা আনুমানিক ২৬০ কিলোমিটার ঘণ্টা মাত্রায় ঘূর্ণিঝড় সহনীয়। রয়েছে বিদেশি প্রতিনিধিদের জন্য আবাস ব্যবস্থা। এছাড়া তাদের জন্য আরও আবাসস্থল নির্মাণ করা হচ্ছে।
ধর্মীয় ইবাদত পালনের জন্য উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহারের জন্য ৩টি শেল্টার স্টেশনকে মডিফাই করা হয়েছে এবং এর কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্তের আলোকে কক্সবাজার ক্যাম্পের ন্যায় বর্ণিত শিক্ষাকার্যক্রম চালু রাখার উদ্দেশে প্রকল্প এলাকায় বিদ্যমান দুটি চারতলা বিশিষ্ট শেল্টার স্টেশনকে মডিফিকেশন করে নন-ফরমাল শিক্ষা কার্যক্রমের সুবিধা রাখা হয়েছে।
ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে ৩৬টি শেল্টারকে মোডিফিকেশন করে দুটি ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে।
প্রকল্পের আওতায় ভাসানচরের প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহের জন্য ২x২৫০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ফুয়েল ট্যাঙ্কের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জন্য দুটি শেল্টারকে রূপান্তর করা হয়েছে।
এছাড়া প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের জন্য একটি, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) প্রতিনিধিদের জন্য একটি, রেডক্রসও আন্তর্জাতিক এনজিওর জন্য একটি, এতিমখানা হিসেবে ব্যবহারের জন্য একটি, ডে কেয়ার সেন্টার হিসেবে ব্যবহারের জন্য একটি, সুপারশপ হিসেবে ব্যবহারের জন্য একটি শেল্টার স্টেশনকে মডিফায়ের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
ত্রাণ সামগ্রী (খাদ্য ও অন্যান্য আইটেম) সংরক্ষণের জন্য এক লাখ রোহিঙ্গাদের আনুমানিক ৩ মাসের খাবার সংরক্ষণের নিমিত্তে চারটি ওয়্যারহাউজ নির্মাণ করা হয়েছে। নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগের জন্য ভাসানচরে একটি গ্রামীণফোন এবং একটি রবি মোবাইল বিটিএস স্থাপন করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রয়াত্ত মালিকানাধীন টেলিটক নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজও চলছে এবং উক্ত এলাকার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও রয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৯৯৭ সালে দ্বীপের সবচেয়ে কাছাকাছি সাইক্লোন এসেছিল। এটি ৭০ কিলোমিটার দূরে ছিল। এছাড়া দ্বীপটিতে কোনো সাইক্লোন হয়নি। তবে পানি উঠেছিল। ভবিষ্যতে যাতে পানি না ওঠে এ জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে ৯ ফিট উঁচু করে। এটি নির্মাণে ২০০ থেকে ২৫০ বুলডোজার কাজ করেছে।’
প্রসঙ্গত, প্রথম বাসিন্দা হিসেবে সেখানে ৩০৬ জন রোহিঙ্গাকে রাখা হয়েছে। এরা প্রত্যেকে অবৈধপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছিলেন। সাগরে ভাসতে ভাসতে তাদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছিল। কিন্তু কোথাও ভিড়তে পারছিলেন না। পরে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ সরকার তাদের আশ্রয় দেয়। এদের মধ্যে ৯৭ জন পুরুষ, নারী ১৭৬ জন এবং শিশু ৩৩।
এইচএস/এফআর/পিআর