দেশজুড়ে

বাপ-দাদার পথে রমেশ, পারাপারে কেটে গেল ৪৭ বছর

গভীর রাত। সবাই ঘুমিয়ে। কেবল ঘুম নেই ৬২ বছর বয়সী রমেশ মাঝির চোখে। ওপারে কে যেন এসে ডাকছে, ও দাদা পার করে নিয়ে যাও। নদীর এপার আর ওপার করতে করতে তার কেটে গেছে দীর্ঘ ৪৭ বছর।

Advertisement

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার জপসা লক্ষ্মীপুর কৃত্তিনাশা নদীর খেয়া ঘাটের মাঝি তিনি। দীর্ঘদিন ধরে নৌকা টানেন তিনি।ওই গ্রামের মৃত জগেশ্বর মাঝি একমাত্র ছেলে রমেশ মাঝি।

দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে জানান, কৃত্তিনাশা নদীটি তিনি কাটতে দেখেছেন। নদীটি কাটার পর পরই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে হামলা চালায়। শুরু হয় যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে স্বাধীন দেশ পায় বাংলাদেশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে লক্ষ্মীপুর কৃত্তিনাশা নদীর খেয়া ঘাটে তার দাদা ধনেঞ্জয় মাঝি কাজ শুরু করেন। পরে তার বাবা জগেশ্বর মাঝি কাজ শুরু করেন।

রমেশ মাঝির বয়স যখন আড়াই বছর তখন তার মা মারা যান। কয়েক বছর পর তার বাবাও মারা যান। তারা চার বোন, এক ভাই। বোনদের মানুষ করতে, বিয়ে দিতে ১৫ বছর বয়সে অভাবের সংসারের হাল ধরতে মাঝির কাজ শুরু করেন রমেশ মাঝি।

Advertisement

রমেশ জানান, তিনি যখন মাঝি হিসেবে কাজ শুরু করেন তখন একজন মানুষ পার করলে ২ পয়সা করে পেতেন। কয়েক বছর পর ৫ পয়সা, ১০ পয়সা, পরে ৫০ পয়সা, এক টাকা, দুই টাকা এবং এখন ৫ টাকা করে নদী পারাপার করেন তিনি। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৭০০ মানুষ পার করেন তিনি। কিন্তু পারাপারে পরিচিতরা টাকা দেন না। তারা বছরে যা ফসল পায় তার একটি অংশ দিয়ে সহযোগিতা করেন রমেশকে।

বাবা মৃত জগেশ্বর মাঝির ঘরে জন্ম নেন রমেশ মাঝিসহ তিন মেয়ে সন্তান। মা-বাবার মৃত্যুর পর তাদের দাদার বাবার কাছ থেকে পাওয়া জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ শতাংশ। সেই জমির মধ্যেই বাড়ি। কোনো আবাদি জমি নেই। রমেশ মাঝির পাওয়া ওই সম্পত্তির মাঝেই সংসারে জন্ম নেয় দুই মেয়ে দুই ছেলে। ইতোমধ্যে চার সন্তানকেই বিয়ে দিয়েছেন তিনি।

দাদা আর বাবার পথ অনুসরণ করে বেছে নেয়া নৌকার মাঝির কাজে কোনোভাবে জীবন আর জীবিকা চালিয়ে অভাব-অনটনে দিন কাটছে তার। তবুও যেন হাল ছাড়ার পাত্র নয় তিনি। তাই কষ্ট হলেও নৌকার মাঝির কাজ করছেন তিনি। এখন সরকারি আর ব্যক্তি সাহায্য-সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে চলছে তার পরিবার।

রমেশ মাঝি বলেন, দুই পারের মানুষগুলো তার আপন হয়ে গেছে। তাই এ পেশা ও মানুষকে ভালোবেসে মাঝির পেশা আকড়ে ধরে আছেন তিনি।

Advertisement

রমেশ আরও বলেন, নৌকা চালানো আমার পেশা। এতদিন অতি যত্নে ধরে রেখেছি। নৌকা চালাতে চালাতে কখন যে কেটে গেল জীবনের ৪৭টি বছর তা বুঝতেই পারিনি। সরকার কৃত্তিনাশা নদীর ওপর (এই ঘাটে) সেতু তৈরি করলে আমার স্বপ্ন পূরণ হতো। সেতুটি হলে এ কাজ থেকে অবসর নিতাম আমি।

রমেশ মাঝির স্ত্রী চায়না রানী (৫৭) বলেন, স্বামীর বয়স হয়েছে। সংসারে চার সন্তান। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। আর ছেলেরা কাঠমিস্ত্রি কাজ করেন। ছেলেরা বিয়ে করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকেন। আমাদের তেমন খোঁজ নেয় না। কষ্টে চলছে আমাদের জীবন। একটি টিনের ঘরে আমাদের স্বামী-স্ত্রীসহ বসবাস।

নৌকা পারাপার হওয়া জপসা ইউনিয়নের আলী চোকদার (৬০) ও আকবর সরদার (৫৮) বলেন, রমেশ ভাই সহজ-সরল মানুষ। ছোট থেকেই তিনি এ ঘাটে বিদ্যালয়, কলেজের শিক্ষার্থীসহ দুই পারের মানুষ পারাপার করেন। তাকে ছাড়া নদীর ওই ঘাট শূন্য লাগে। আমরা এলাকার মানুষ রমেশ ভাইকে অনেক ভালোবাসি।

জপসা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক মাদবর (৫২) বলেন, নৌকার মাঝি রমেশ অতিদরিদ্র ব্যক্তি। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি রমেশ মাঝি নৌকা পারপার করে জীবনযাপন করেন। তার দাদা আর বাবাও এই নৌকার মাঝি ছিলেন।

জপসা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শওকত বয়াতী বলেন, হতদরিদ্র ও নৌকার মাঝি রমেশ আমার ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি অনেক ভালো মনের মানুষ। তাই ব্যক্তিগতভাবে মাঝে মধ্যে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকি। তাছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভিজিডি চালের কার্ড করে দেয়া হয়েছে। কার্ডে ৩০ কেজি করে চাল পায় তিনি।

মো. ছগির হোসেন/এমএএস/পিআর