ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অধীন ৪৯টি থানায় প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০টি করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) লেখা হয়। তবে প্রতিদিন এতো সাধারণ ডায়ারি হলেও এর অধিকাংশই থেকে যায় ফাইলবন্দি। গুরুত্ব অনুসারে জিডির কোনো ক্যাটালগও নেই ডিএমপি কিংবা পুলিশ সদর দফতরে। শুধু তাই নয়, কোন কোন জিডির দ্রুত গতিতে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন সে সম্পর্কেও নেই সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা। ডিএমপির বিভিন্ন থানা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।সূত্রে জানা যায়, থানায় দায়েরকৃত সাধারণত হত্যার হুমকি, চাঁদাবাজির হুমকি, শ্লীনতাহানি, ছিনতাই, ল্যাপটপ চুরি, মোটরসাইকেল চুরিসহ সব ধরণের যানবাহন হারানো ইত্যাদি অভিযোগে জিডি করা হয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ জিডি দায়েরকারীর অভিযোগ- জিডির ব্যাপারে পুলিশের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। হত্যার হুমকির কারণে জিডি করলেও নিরাপত্তা দেয়া কিংবা বিষয়টি খতিয়ে দেখার ক্ষেত্রে পুলিশের রয়েছে গাফিলতি। তদন্ত কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বাদীর অভিযোগ শুনতে মোটেই আগ্রহ দেখান না।এ ব্যাপারে আইন বিশেষজ্ঞরা জাগো নিউজকে বলেন, মানুষের `জান-মালের` নিরাপত্তা চেয়ে প্রথম আইনি ধাপটিই হল জিডি। আর সেই জিডির তদন্ত করতে যদি পুলিশ গড়িমসি করে তাহলে নতুন অপরাধ সংগঠনের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে।ভুক্তভোগীরা জানান, অধিকাংশ জিডির ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করে থানা পুলিশ। কিন্তু অনেক সময়ই বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ও ছোট-বড় যানবাহন হারানোর পর থানায় জিডি করা হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে জিডি দায়েরকারী ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হয় না। ডিএমপি ও পুলিশ সদর দফতর বলছে, শুধু রাজধানীর থানাগুলোতে বছরে ৫ লক্ষাধিক জিডি লেখা হয়। প্রতিদিন থানা ভেদে কমপক্ষে ৪০টি করে জিডি দায়ের হয়। হাজার হাজার মামলা তদন্তের জন্যই যেখানে পর্যাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা নেই সেখানে সব জিডির তদন্ত করা অসম্ভব।পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁওয়ের দক্ষিণ গোড়ানে ভাড়া বাসায় ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মী নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (২৭) দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন হন।নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী আশামনি দাবি করেন, ‘পুলিশ খুনিদের ধরতেও পারে না, আবার নিরাপত্তা চাইলে নিরাপত্তাও দিতে পারে না। এমন পুলিশ রেখে লাভ কী?’তিনি আরও জানান, গত ১৫ মে খিলগাঁও থানায় ও পরদিন শাহজাহানপুর থানায় নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করতে গেলেও জিডি নেয়নি পুলিশ। জিডি নেয়ার পর যদি তদন্ত হতো তাহলে স্বামীকে মরতে হতো না।অন্যদিকে এ ফেইসবুক স্ট্যাটাসে ও থানায় জিডি করে নিজের জীবননাশের হুমকি-ধমকির কথা জানিয়েছিলেন শুদ্ধস্বর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল। কিন্তু নিরাপত্তা পাননি বলে অভিযোগ ওঠেছে। গত শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে লালমাটিয়াস্থ সি ব্লকের ৮/১৩ নং চারতলায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ৫ জনকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে ও গুলি করে আহত করে।আহত টুটুলের স্ত্রী শামীম রুনা সাংবাদিকদের বলেন, হুমকি-ধমকির কারণে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুর থানায় একটি জিডি করা হয়। কিন্তু নিরাপত্তা পায়নি। সে কারণেই হামলার শিকার হয়েছেন তিনি (টুটুল)।ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মী দেবজ্যোতি জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, পুলিশ মুক্তমনা লেখক ও প্রকাশকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। নীলাদ্রী জিডি করতে গেলেও পুলিশের অসহযোগীতায় জিডি লেখা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে টুটুল ভাই জিডি করেও নিরাপত্তা পাননি।এবিএম জাহিদুল ইসলাম নামে পশ্চিম আগারগাঁও এর এক বাসিন্দার অভিযোগ, দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া ও সহযোগীতার জন্য শেরে-বাংলা থানায় একটি জিডি করেছি। জিডিতে সম্পত্তির মালিকানা পরিবর্তনে আইনগত সহায়তা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কোনো যোগাযোগ করেননি থানা পুলিশ।দামি স্মার্টফোন হারানোর দেড় বছর হলো মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র জাকিরুল ইসলাম জনি। কিন্তু আজও পুলিশ কোনো খোঁজ খবর জানাননি বলে জানান জনি।এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ জাগো নিউজকে বলেন, হুমকির বিষয়ে জিডি হলে থানা পুলিশ মোবাইলের কললিস্ট পাঠায় ডিবিতে। সেখান থেকে হুমকি দাতাকে সনাক্ত করতেই মাস পেরিয়ে যায়। এতো দিনে হুমকি দাতার স্থান বদলে যায়।তিনি আরও বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে জিডি নিষ্পত্তি করতে গেলে আগে পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পুলিশের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন না ঘটলে জিডি নিষ্পত্তি সম্ভব নয় বলে আমার অভিমত।ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, “জিডির তদন্ত না হলে অনেক ক্ষেত্রে হত্যাকাণ্ড কিংবা হামলার ঘটনাও ঘটতে পারে। যা ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছি। সুতরাং আমি মনে করি- পুলিশের সক্ষমতা বাড়িয়ে গুরুত্ব অনুসারে জিডি নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।”পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল আহছান জাগো নিউজকে বলেন, পুলিশ সদর দফতরে সাধারণত জিডির কোনো ক্যাটালগ নেই। আপাতত পুলিশ সদর দফতরে মামলার রেকর্ড রয়েছে।ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, ডিএমপিতে ৪৯টি থানা। সব থানার জিডির পরিসংখ্যান রাখা সম্ভব হয় না।তিনি আরও বলেন, “থানায় যে পরিমাণ জনবল তা দিয়ে তো মামলার তদন্ত কাজ করতেই হিমশিম খেতে হয়, সেখানে সব জিডির তদন্ত সত্যিকার অর্থেই কষ্টসাধ্য। তবে থানা পুলিশ জিডির গুরুত্ব অনুযায়ী তদন্ত করে থাকেন।”এদিকে জিডি করেই তাৎক্ষণিক ফল পেতে চায় ভুক্তভোগীরা। কিন্তু অনুসন্ধান ছাড়া তো আর পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। সব জিডির তদন্ত চাইলে পুলিশ সদস্য দ্বিগুন করতে হবে বলেও জানান তিনি।জেইউ/আরএস/পিআর
Advertisement