প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষমতা পেয়েছে বিএনপির তৃণমূল। এজন্য দলের পক্ষ থেকে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করে চিঠি পাঠানো হয়েছে তৃণমূলে। ওই চিঠি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তারা।
Advertisement
নীতিমালায় বলা হয়েছে, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রতিটিতে স্থানীয় পর্যায়ের পাঁচজন নেতা আলোচনাক্রমে একক প্রার্থী মনোনয়নের জন্য লিখিত সুপারিশ করবেন। সে অনুযায়ী ইতোমধ্যে আসন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৪৯ প্রার্থীর নামও চূড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু স্বচ্ছতা বাড়াতে বাছাই কমিটিতে নেতার সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি নীতিমালায় কিছু সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতারা। একই সঙ্গে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ‘পার্লামেন্টারি বোর্ড’ কর্তৃক প্রার্থী চূড়ান্তের কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না বলেও জানান তারা।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, উপজেলা পরিষদের জন্য জেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক— এই পাঁচজন মিলে প্রার্থী মনোনয়নের সুপারিশ করবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, উপজেলার সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকই প্রার্থী হতে চান। পৌরসভার চিত্রও কোনো কোনো জায়গায় একই।
এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকসহ পাঁচজন মিলে প্রার্থী মনোনয়নের জন্য লিখিত সুপারিশ করবেন। কিন্তু অনেক জায়গায় এ তিনজনই প্রার্থী হচ্ছেন। খোদ সুপারিশকারীরা প্রার্থী হলে তখন কী করা হবে, তা নিয়ে নীতিমালায় স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। এছাড়া কিছু কিছু জেলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক, পৌর ও উপজেলার সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক এলাকায় থাকেন না। পরিবারসহ ঢাকায় থাকেন। অথচ পৌর ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে তাদের সুপারিশের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রেও কেন্দ্রের একটা নির্দেশনা থাকা দরকার।
Advertisement
নতুন নীতিমালার কারণে তৃণমূলে গ্রুপিং ও অন্তর্কোন্দল দেখা দেয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে দলের একাংশের নেতার ভাষ্য, এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়, এটা ঠিক। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা প্রার্থী ছিলেন তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল। অথচ তাদের কোনো ক্ষমতাই দেয়া হয়নি। যে কারণে তৃণমূলে গ্রুপিং আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী প্রার্থী মনোনয়নে উপজেলার শীর্ষ দুই নেতার সুপারিশ দরকার। তারা চাইবেন, তাদের বলয়ের নেতাদের নাম সুপারিশ করতে। সেক্ষেত্রে উপজেলার নেতাদের সঙ্গে সংসদ নির্বাচনে যারা প্রার্থী ছিলেন তাদের একটা দূরত্ব তৈরি হবে, যা ভবিষ্যতে দলের ওপর প্রভাব পড়বে— মনে করেন তারা।
সূত্র মতে, বিএনপির দফতরে ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে কয়েকটি জায়গায় অনিয়মের কথা জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতারা। তারা স্বচ্ছতা বাড়াতে বাছাইকারী নেতার সংখ্যা পাঁচজনের পরিবর্তে ১০ জনে বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া তৃণমূল নেতাদের সুপারিশ কেন্দ্রে যাওয়ার পর প্রার্থী চূড়ান্তের প্রক্রিয়া নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন।
দলের গঠনতন্ত্রে বলা আছে, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য কিংবা অন্য যেকোনো নির্বাচনে দলের প্রার্থী মনোনয়নের জন্য একটি পার্লামেন্টারি বোর্ড থাকবে। দলের স্থায়ী কমিটি দিয়ে হবে পার্লামেন্টারি বোর্ড। দলের চেয়ারম্যান হবেন এ বোর্ডের সভাপতি।’
Advertisement
অথচ আসন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য সম্প্রতি ৪৯ প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে যেখানে গঠনতন্ত্র মানা হয়নি। অর্থাৎ পার্লামেন্টারি বোর্ডের বৈঠকে এসব প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়নি। নতুন নীতিমালার আলোকে প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূল নেতারা সুপারিশ করার পর দলের কোন ফোরামে আলোচনা করে তা চূড়ান্ত হলো— বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই অন্ধকারে!
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে গত ১৯ সেপ্টেম্বর কেন্দ্র থেকে বিএনপির তৃণমূল নেতাদের কাছে নীতিমালাটি পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, ‘উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব/১নং যুগ্ম আহ্বায়ক (দুজন), উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও ১নং সাংগঠনিক সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক, সদস্য সচিব ও ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক— এই পাঁচজন আলোচনাক্রমে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের জন্য লিখিত সুপারিশ করবেন।
পৌরসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব/১নং যুগ্ম আহ্বায়ক (দুজন), পৌরসভা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও ১নং সাংগঠনিক সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক, সদস্য সচিব ও ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক পরস্পর আলোচনা করে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের জন্য লিখিত সুপারিশ করবেন।
এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব/১নং যুগ্ম আহ্বায়ক (দুজন), ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক, সদস্য সচিব ও ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক আলোচনাক্রমে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের জন্য লিখিত সুপারিশ করবেন। তৃণমূল নেতাদের সুপারিশ অনুযায়ী প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে।
এ প্রসঙ্গে পিরোজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দলের নীতিমালা রয়েছে। কিছু ব্যাপারে আমরা অলিখিতভাবে চর্চা করি, সেগুলো নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করলে মনোনয়ন প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ হবে বলে আমি মনে করি।
বিএনপির এক সময়ের তৃণমূল পুনর্গঠনের দায়িত্বে থাকা নেতা ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাজাহান বলেন, তৃণমূলে নেতৃত্ব বাছাই করার সিদ্ধান্তটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় কিছু ত্রুটি থাকলে বা প্রক্রিয়াটিকে আরও সমৃদ্ধ করার দরকার হলে তা করা হবে।
এ ব্যাপারে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীরাই দলের প্রাণশক্তি। সব সময়ই বিএনপি তাদের মতামতকে মূল্যায়ন করেছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেছে, এটাও সত্য। এবার স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত, দলের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিতের অংশ হিসেবে তৃণমূলকে আরও প্রাধান্য দেয়া হবে। তারাই নির্ধারণ করবেন, তাদের প্রতিনিধি হওয়ার জন্য কে যোগ্য।
কেএইচ/এমএআর/পিআর