জাতীয়

শিশুরা স্কুলবিমুখ : ঝরেপড়া ও বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা

করোনাভাইরাস প্রকোপের কারণে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুলবিমুখ হয়ে পড়ছে। বিশেষত মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়ার হার বাড়ছে, বেড়ে যাচ্ছে বাল্যবিয়ে। এমনিতেই বাল্যবিবাহের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তারওপর গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে এ হার বেড়েছে ২২০ শতাংশ পর্যন্ত। বিশিষ্টজনেরা আশঙ্কা করছেন, স্কুল খুলতে দেরি হওয়ার সঙ্গে এই সমস্যাগুলোও বাড়তে পারে।

Advertisement

রোববার (১১ অক্টোবর) বিকেলে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে এক ডিজিটাল সংলাপ অনুষ্ঠানে বক্তারা এই অভিমত ব্যক্ত করেন। আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এই সংলাপের শিরোনাম ছিল ‘মেয়েদের স্কুলে ফেরাতেই হবে’।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। আরও উপস্থিত ছিলেন নারীঅধিকারকর্মী এবং সংসদ সদস্য অ্যারোমা দত্ত, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আমেনা বেগম, ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাডভাইজার তাহেরা জাবীন, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (ডেভেলপমেন্ট) সাইমন বাকলি। সংলাপটি সঞ্চালনা করেন ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি কর্মসূচির পরিচালক নবনীতা চৌধুরী।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘ডিজিটাল ক্লাস করানোর ক্ষেত্রে আমরা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। টেলিভিশনে ক্লাস নেয়ার মানও বেড়েছে। শুধু সরকার নয়, বেসকারি পর্যায়েও অনেক প্রতিষ্ঠান এভাবে ক্লাস নিচ্ছে। তাই শিক্ষার্থীদের যে এই পরিস্থিতিতে স্কুলে যেতেই হবে- এমনটি ভাবা যাবে না। অনেক দেশে তো স্কুল খোলার পর আবার বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আমাদেরও বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

Advertisement

কন্যাশিশুদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখন প্রতিটি ইউনিয়নে জন্মনিবন্ধন ডিজিটালাইজড হয়ে যাচ্ছে। তাই ভুয়া সনদ দেখিয়ে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দেয়া যাবে না। আর স্কুলের পাঠক্রমে নারী অধিকার, যৌন হয়রানি প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। শুধু কোভিড সংকট নয়, আগামীর সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাচ্ছি আমরা।’

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, ‘টানা স্কুল বন্ধ রাখলে শিশুরা যা শিখেছে, তা-ও ভুলতে বসে। পাকিস্তানে এক গবেষণায় দেখা গেছে, পাঁচ মাস স্কুল বন্ধ রাখার পর শিশুরা শিক্ষাক্ষেত্রে ১৪ মাস পিছিয়ে গেছে। আমাদের দেশে এটা নিয়ে ভাবতে হবে। স্কুলগুলো হুট করে না খুলে পর্যায়ক্রমে মনিটরিং করে খুলতে হবে। যেমন- যেসব জেলায় সংক্রমণ কম সেসব স্থানে আগে খোলা। এ বিষয়ে কাজ করতে সরকারকে সহযোগিতা করতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রস্তুত।’

সংসদ সদস্য অ্যারোমা দত্ত বলেন, ‘আমাদের বাস্তবতা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটা সত্য যে, এই মহামারিতে আমরা কিছু হারিয়েছি, আরও কিছু হারাব। স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার অবশ্যই বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের বিশেষত আমাদের মেয়েদের জন্য প্রযুক্তিগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে যাতে প্রয়োজনের সময় তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। বাবা-মা এখনও বিশ্বাস করে যে মেয়েদের শিক্ষিত করা তাদের বিয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করবে। আমাদের এই মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।’

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘স্কুল বন্ধ রাখার কারণে ছাত্রদের ক্ষতির পাশাপাশি শিক্ষকরাও বিপদে আছেন। এই মহামারিটা আমাদের সামনে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মতো। আমরা ভুলভ্রান্তি ও করণীয় সম্পর্কে নতুন করে শিখতে পারছি। সবাইকে স্কুলে ফেরানোর আগে তথ্য-উপাত্ত ও বাস্তবতা যাচাই করে দেখতে হবে।’

Advertisement

তিনি শিক্ষামন্ত্রীকে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাতেও প্রণোদনার, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, ছাত্রদের টিফিন প্রভৃতির ব্যবস্থা রাখা অনুরোধ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘এই কোভিড-১৯ সংকট চলাকালীন আমরা দেখেছি শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সুতরাং আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করতে পারি না। দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে প্রায় ৪৩ শতাংশ পরিবার। এই পরিবারগুলোতে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচুর শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের জন্য কী করা যেতে পারে সে সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনা করা উচিত।’

ব্রিটিশ হাইকমিশনের সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাডভাইজার তাহেরা জাবীন বলেন, ‘১০৫টা দেশে স্কুল খুলে দিয়েছে। শিশুদের জন্য একটা গাইডলাইন করা দরকার। সেখানে পরিবারের সম্পৃক্ততা থাকা জরুরি। সরকারি-বেসরকারি ও দাতা সংস্থাকে এদিকে নজর দিতে হবে।’

পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম বলেন, ‘অনেক পরিবার মনে করছে, মেয়েমানুষের এত পড়াশোনার কী দরকার? অনেক সময় মা-বাবা জোর করেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। মহামারিটির শুরুর দিকে, কী করা উচিত সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিষ্কার ছিল না। বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে ৯৯৯-এ ডায়াল করে সহায়তা পেতে পারে- শিক্ষার্থীদের এ সম্পর্কে সচেতন করার জন্য আমরা স্কুল প্রোগ্রামগুলোতে কাজ করছি। যে ভালো স্পর্শ, মন্দ স্পর্শ বিষয়ে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- এ জন্য মন্ত্রীকে ধন্যবাদ।’

অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি সাইমন বাকলি বলেন, ‘স্কুল থেকে দূরে থাকায় বাদ পড়ার ঝুঁকি বাড়ে। যখন বিদ্যালয়গুলো আবার চালু হবে, তখন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়েরই জোর প্রচেষ্টা থাকতে হবে- আগের ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেয়া যায়। তবে তাদের এই যেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে না হয়।’

এমইউ/বিএ/জেআইএম