সাহিত্য

জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়

শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি নামলো। দূরে কোথাও একঘেয়ে বিধবার কান্নার মতো মন খারাপ করিয়ে দেয়া বিহ্বল বৃষ্টি। লাগাতার এই ঝুম বৃষ্টি বহুকাল আগে ফেলে আসা কোন স্মৃতিকে উস্কে দেয় যেন। স্মৃতির জানালা খুলে চেয়ে থেকে, নাগরিক জানালার সংক্ষিপ্ত আকাশের প্রেক্ষাপটে হাত বাড়িয়ে ছোয়ার চেষ্টা করি সে বৃষ্টিকে। যেভাবে খাকি চত্বরের দিনগুলোতে করিডরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখার আড়ালে গোপন করতাম মনের কোন অজানা ব্যথাকে। হঠাৎ স্টকহোম সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। চোখের পাতা ক্রমশই ঝাপসা হয়ে আসে। পেছন থেকে শুনি অস্পষ্ট স্বরে কেউ ডাকছে গাবদা, এই গাবদা। গাবদা মানে আমাদের ওয়াহেদ। আদর করে নাম দিয়েছিলাম গাবদা। একটু মোটা ছিল। খাকি চত্বরের আধাসামরিক পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে একটু কষ্টও হয়তো হয়েছিল। এক বিকেলের কথা। আর্মির এক স্টাফ গাবদাকে প্যারেড শেখাচ্ছেন। গাবদার মোটা দেহ বেয়ে দরদর করে ঘাম নামছে। ততক্ষণে গেমস আওয়ার শেষ। সবাই যে যার মতো রুমে চলে গেছে। শুধু গাবদাকে তখনো প্যারেড গ্রাউন্ডে রেখে দেয়া হয়েছে। কোনো একটা ভুল করেছে হয়তো।

Advertisement

কৈশোরে বাবা-মা কে ফেলে জীবন গড়ার এক মহান তাগিদে নিজেকে আবদ্ধ করা ব্রিটিশ নিয়মে পরিচালিত সেনানিয়ন্ত্রিত এই কুঠুরিতে। সেই সন্ধ্যার এই কষ্টময় মুহূর্ত চোখে যেতেই স্টাফকে অনুরোধ করলাম ওকে ছেড়ে দেবার। স্টাফ অনুরোধ রাখলেন। গাবদা কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু একটা বলতে চাওয়ার প্রবল আকুতি ওর সমস্ত চোখে মুখে। হুট করে অগ্রজদের সাথে কথা বলার নিয়ম নেই এ চত্বরে। তাই হয়তো ও নীরবে প্রস্থান করেছিল। গাবদার সাথে পরবর্তী দেখা ক্যান্টিনে। উপচে পড়া ভিড়ের মাঝে সিনিয়রদের অতিক্রম করে কিছু কেনা অসম্ভব ছিল। ব্যাপারটা চোখে পড়তেই ভিড় ঠেলে ওকে কিছু কিনে দিলাম। আর বললাম, ঐ গাবদা, তোমার এই টিজ নাম কে দিয়েছে? ও চাপা স্বরে বলল, ভাইয়া সবাইত এ নামেই ডাকে। গাবদার চোখে লজ্জার আভা। ভাবলাম এভাবে সবার সামনে ওকে গাবদা ডাকা হয়তো ঠিক হয় নি। গাবদা চলে যাওয়ার পর মনে হল, ওর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারতাম। কেন জানি না অজ্ঞাত কারণে ওকে খুব পছন্দ করতাম। কিন্তু এ এমন এক অদ্ভুত জগত যেখানে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কের হায়ার্কি ভেদ করে ভালোবাসা প্রকাশ করা কঠিন। অনুভব করতাম মোটা হওয়ার কারণে ইউনিফর্ম শারীরিক কাঠামোর খাকি কিশোরদের মাঝে ও কিছুটা বেমানান। ফলে ওর ভেতরে কিছু চাপা কষ্ট আছে। সবাই ওকে তাচ্ছিল্য করে। সেই চাপা কষ্ট ও কাউকে বলতেও হয়তো চায়। একবার ভাবলাম ওকে রুমে ডাকবো। কথা গুলো শুনবো। সেদিন সবার সামনে ‘গাবদা’ বলে ডাকার জন্য সরিও বলবো।

গাবদার কথাগুলো শোনা কিংবা সরি বলা কোনটাই করা হয় নি আর। এক সকালে গাবদা চলেই গেল হুট করে। যদিও গাবদার এই আচমকা চলে যাওয়ায় অবাক হয়েছিলাম খুব, সঙ্গে বিপন্নও বোধ করেছি প্রচুর। সকালে রুটিন মাফিক দৌঁড়াচ্ছিলাম। হঠাত্ দেখি চত্বর জুড়ে দারুণ তোরজোর, ব্যতিব্যস্ততা। সকালের নিয়মমাফিক তিন চক্কর দৌড়ের দ্বিতীয় চক্করে তখন সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাচ হিসেবে হাঁটছি। এই ব্যতিব্যস্ততায় কিছুটা থামকে যাই যেন। দেখি কলেজের একটা গাড়ি ধরার ধুলি উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে আমাদের অজানা কোনো গন্তব্যের দিকে। পরে শুনতে পাই, কেউ একজন দৌঁড়াতে গিয়ে পড়ে গিয়েছে। তাকেই নেয়া হচ্ছে এ গাড়িতে করে শহরের কোনো চিকিৎসালয়ে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য। যেসব চিকিৎসা কলেজের হাসপাতালে দেয়া সম্ভবপর নয়, সেসব চিকিৎসার জন্য ক্যাডেটদের শহরের মেডিকেলে পাঠানোর নিয়ম যেহেতু পুরনো, তাই এই ঘটনা আমাদের তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ভাবান্তর ঘটায় না। আমরা আগের মতোই তিন চক্কর দৌড় শেষ করে হাউজে গিয়ে গোসল করে ব্রেকফাস্টে ব্রেডের সাথে বাটার মাখিয়ে খাই। ক্লাসরুমে গিয়ে অপেক্ষা করি ক্লাস করবার। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় পিরিয়ডে দেখি আমাদের হিরোয়িক ইমেজের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক নিজাম স্যার কাঁদছেন। কোথাও কোনো গন্ডগোল অনুভব করে আমরা কেমন আতঙ্কিত হয়ে উঠি, ভাবি পৃথিবীর কোথাও কান্নার মতো কিছু ঘটেছে কি? এসব ভাবনার আড়ালে আমাদের কানে আসে হাওয়ায় ভেসে আসা বিবিধ টুকরো খবর। সেসব খবর আমরা শুকনো পাতার মতো উড়িয়ে দেই। কিন্তু এইসব টুকরো খবর জোড়া দিয়ে আমরা যে বৃহৎ সংবাদ পাই তা হলো, গাবদার ফেরা। তবে, সে ফেরা ক্ষণিকের। একটু পরেই এ চত্বর থেকে চলে যাবে ও। তাই শেষবারের মতো কলেজ যেন গাবদাকে দেখতে পারে সেই আয়োজন চলছে।

কলেজ মসজিদের সামনে দেখতে পাই গাবদাকে দেখার আনুষ্ঠানিক আয়োজন চলছে। কিছুক্ষণ পরই চলে যাবে গাবদা, আমাদের ওয়াহেদ। চিরদিনের জন্য। অথচ, এই চত্বরেই একত্রে বহুদিন, বহু সময় আমরা একত্রে কাটিয়েছি। সবাই গাবদাকে শেষ বারের মতো দেখছে। অন্য সবার মতো আমিও সুসজ্জিত গাবদাকে দেখতে যাই। সন্ধ্যার সংক্ষিপ্ত আলোয় দেখি মায়াবীকরুণ এক কিশোরের নিরপরাধ ঘুম জর্জরিত স্থির ফটোগ্রাফের মতো একখানা মুখ। কিছু একটা বলতে চাওয়ার প্রবল আকুতি তখনও ফুটে রয়েছে সে মুখের মাধুর্যে। এক সময় চলে যায় ওয়াহেদ। আমাদের গাবদা। কলেজের বিশেষ ব্যবস্থায় ওকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরে অবশ্য জেনেছিলাম গাবদার চলে যাওয়ার কারণ। কলেজ অধ্যক্ষ বিশেষ অ্যাসেম্বলি ডেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে পাঠ করে গাবদার চলে যাওয়ার এলিজি। তিনি জানান, সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। স্ট্রোক করার পর মাত্র বিশ মিনিট বেঁচে ছিল ও।

Advertisement

সে রাতে জীবনানন্দের শহর থেকে সাতমাইল দূরের এই নিঝুম পল্লীতে নেমে আসে পিন ড্রপ সায়লেন্স। বুকের ভেতর শূন্যতার স্রোতগুলো পরিদর্শন সারির মতো বয়ে যায় মেলানকোলিং যূথবদ্ধতায়। এরপর থেকে মাঝরাতে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যেত। কখনো আধসামরিক জ্যোৎস্নায় ভেসে যেতো আমাদের খাকি চত্বর। বর্ষীয়ান নেতা সোহরাওয়ার্দীর সম্মানে নামকরণকৃত ছাত্রাবাস, যাকে হাউস নামে ডাকা হয়, এরই ৩০৪ নাম্বার রুমের শেষ বিছানায় মাথার নিচে একটা অস্বস্তিকর বালিশ চেপে ভাবতাম অনাগত ভবিষ্যতের কথা। ঘুম না আসা রাতে মনে পড়তো গাবদাকে। প্রায়শই প্রবল জোছনায় ভেসে যেতো চত্বর। ‘মৌসুমি সমুদ্রের পেটের’ মতো ফুলে ওঠা মশারির ওপর ফুটে থাকতো অপূর্ব জ্যোৎস্না ফুল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতাম, অস্বচ্ছ জোছনার আবছায়া মায়াবী আলোয় একটি ছায়া মূর্তি। দূর থেকে মনে হতো, এ যেন গাবদা। দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বিস্মৃতির সকল গানের ওপারে। কেমন এক ঘোরলাগা জাদুবাস্তবতা যেন। চারদিক থেকে অজস্র কন্ঠের ডাক ভেসে আসতো। সম্মিলিত সুরে সবাই ডাকছে, গাবদা, গাবদা, গাবদা…।

গাবদার চলে যাওয়ার দিনটি ছিলো ১০-১০-১০। আজ ১০-১০-২০-এ এসে ক্যালেন্ডারের পাতায় শতাব্দী ঘুরে মাত্র একবার আসা দিনটির কথা ভেবে কেমন ব্যথিত হই। গাবদা চলে যাওয়ার আগের রাতে সহপাঠীদের জানিয়েছিলো, দিনটাকে ও যে করেই হোক স্মরণীয় করে রাখবে। কে জানতো, বছর ঘুরে অক্টোবরের দশ তারিখ এলেই বিস্মৃতির অতল থেকে গাবদা উঠে এসে জানান দেয়-

“এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসি খেলায়আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।শুকনো ঘাসে শূন্য বনে আপন-মনে অনাদরে অবহেলায়আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।”

এইচএন/এইচআর/এএ/এমএস

Advertisement