বিশেষ প্রতিবেদন

নিরাপত্তার অভাব সিরাজগঞ্জের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে

সিরাজগঞ্জের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সেবা দান করে আসলেও সেখানে নেই যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্লিনিকগুলোতে দেয়া হলেও রাতের আঁধারে এ সকল যন্ত্রপাতি রক্ষার জন্য কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। যে কারণে রাতে ক্লিনিকগুলোতে চোরের দল হানা দিয়ে সব কিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। চুরির পাশাপাশি আধুনিক এই যন্ত্রপাতিগুলো রক্ষণাবেক্ষণেরও অভাব দেখা গেছে। ক্লিনিকগুলো সকাল ৯টার মধ্যে খোলার কথা থাকলেও তা ১০টা বা আরও পরে খোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সপ্তাহে ছয় দিন ক্লিনিকগুলো চালু থাকার কথা থাকলেও অনেক ক্লিনিক সপ্তাহে চার দিন বা পাঁচ দিন খোলা থাকে বলেও অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক ক্লিনিকে কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) আসলেও নিয়মিত ক্লিনিকে আসেন না ফ্যামিলি ওয়েল ফেয়ার অ্যাসিসটেন্ট (এফডাব্লিউএ) ও হেলথ অ্যাসিসটেন্ট (এইচএ)। একমাত্র কর্মী হওয়ায় সঠিকভাবে সেবা প্রদান করাও সম্ভব হচ্ছে না বলে অনেক ক্লিনিকের সিএইচসিপি অভিযোগ করেছেন। সিরাজগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পরিসংখ্যান অফিসার মির্জা হুমায়ন কবীর জাগো নিউজকে জানান, জেলায় মোট ৩৪০টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে ৩৩৮টি ক্লিনিকে সিএইচসিপি পদে লোক নিয়োগ রয়েছে। বাকি দুটি ক্লিনিকে এই পদে খুব শীঘ্র নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। তবে এই দুটি ক্লিনিক এফডাব্লিউএকে দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে জেলায় ৫১৮ জন হেলথ অ্যাসিসটেন্ট কাজ করে যাচ্ছে। এ সকল ক্লিনিকে ২৮ রকমের ওষুধ প্রদান করা হয়। পর্যাপ্ত ওষুধের মজুদ রয়েছে। কিন্তু দিন দিন ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। সিরাজগঞ্জ সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে শিয়ালকোল ইউনিয়নের সিলন্দা কমিউনিটি ক্লিনিকে সরেজমিন দেখা যায়, সিরাজগঞ্জ-বগুড়া মহাসড়কের পাশে ধানক্ষেতের মাঝখানে নির্মাণ করা হয়েছে এই ক্লিনিক। ক্লিনিকে যাবার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খাবাপ। ক্লিনিকে প্রবেশ করতে হলে জমির আইল (চিকন রাস্তা) ধরে যেতে হয়। কোনো গুরুতর অসুস্থ রোগীকে এই রাস্তা দিয়ে ক্লিনিকে নেয়া খুবই কষ্টকর। সকাল পৌনে ১০টার সময় সিএইচসিপি ওয়াহিদুর রহমান ক্লিনিকটি খুললেন। ভেতরে গিয়ে দেখা যায় ক্লিনিকের আসবাবপত্র ছাড়া কোনো যন্ত্রপাতি নেই। খবর নিয়ে জানা যায়, এই ক্লিনিকে গত কিছুদিনের মধ্যে চারবার চুরি হয়েছে। সর্বশেষ গত মাসের চুরিতে ক্লিনিকের ওয়েট মেশিন, থার্মোমিটার, ব্লাড প্রেসার মেশিন, সকল ওষুধসহ ক্লিনিকে দামি সব কিছুই চুরি হয়ে গেছে। সকাল ১০টার পর থেকে রোগী আসতে শুরু করলো। বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ৫৩ জন রোগী এই ক্লিনিকে সেবা নিতে আসলেন। তবে এরপর আর কোনো রোগীকে এই ক্লিনিতে আসতে দেখা যায়নি। এদিকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ক্লিনিকে এফডাব্লিউএ রোখসানা খাতুন ও এইচএ সুফিয়া খাতুন ক্লিনিকে আসেননি। খবর নিয়ে জানা যায়, ওই দিন তারা ক্লিনিকে আসবেন না। তবে এ ক্লিনিকে ২ জন এফডাব্লিউএ পালাক্রমে তাদের দায়িত্ব পালন করেন। রাশিদা পারভীন শনিবার থেকে সোমবার ও রোখসানা খাতুন মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও অধিকাংশ সময়ই তারা ক্লিনিকে আসেন না। ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগই জ্বর, আমাশায়, সর্দি, কাশি, গ্যাসট্রিকের রোগী। খবর নিয়ে জানা যায়, গুরুতর রোগে আক্রান্তরা এই ক্লিনিকে সেবা নিতে আসেন না। দু একজন আসলেও তাদের জেনারেল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই ক্লিনিকে প্রসূতিরাও খুব একটা আসেন না। অক্টোবর মাসে তিনজন প্রসূতি রোগী এই ক্লিনিকে সেবা নিয়েছেন। ক্লিনিক এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে জানান, সপ্তাহে পাঁচদিন এই ক্লিনিকটি খোলা হয়। সকাল ১০টার দিকে খোলে আর দুপুর হতে না হতেই তা বন্ধ করে দেয়া হয়। রোগীর সংখ্যা হয় অনেক। ছোটখাটো অসুখ হলেই মানুষ এখানে আসে। বাকিরা শহরের হাসপাতাল থেকেই চিকিৎসা সেবা নেন। অনেকে অভিযোগ করেন সঠিকভাবে ওষুধ দেয়া হয় না। তাছাড়া এখানে কোনো পরীক্ষা নিরিক্ষার ব্যবস্থাও নেই। এই ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা শ্যামপুর গ্রামের সবাধন খাতুন (৭৭) জাগো নিউজকে জানান, বাড়ির কাছে ক্লিনিকটি হওয়ায় চিকিৎসা পাবার জন্য মাঝে মাঝেই এখানে আমি আসি। টাকা পয়সার অভাবে শহরে গিয়ে ভালো চিকিৎসা নিতে পারি না। বাতের ব্যাথায় খুব কষ্ট হয়। এখানে চিকিৎসা নিয়েও তেমন ফল পাচ্ছি না।চিকিৎসা নিতে আসা সিলন্দা গ্রামের হাফেজ মোস্তফা (৪৫) কামাল জাগো নিউজকে জানান, কয়েকদিন ধরেই কানের ব্যাথায় ভুগছি। কয়েকদিন আগে এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছিলাম। ক্লিনিক থেকে ওষুধও দেয়া হয়েছিলো। তবে কানের ব্যাথা কমেনি বলেই আবারো এখানে এসেছি। জ্বরে কাতর সিলন্দা গ্রামের সোলেমান হোসেন (৫৫) জাগো নিউজকে জানান, বাড়ির কাছে এমন একটি ক্লিনিক হওয়ায় দ্রুত সেবা নিতে পারছি। বড় ধরনের কোনো চিকিৎসা না পেলেও ছোটখাটো অসুখের চিকিৎসা পেয়ে এলাকার মানুষ খুবই উপকৃত হচ্ছেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানালেন তিনি। সিলন্দা কমিউনিট ক্লিনিকের হেলথ প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) ওয়াহিদুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, তিনি এখানে যোগদান করার আগে দুবার ও যোগদানের পরে আরো দুবার এই ক্লিনিকে চুরি হয়েছে। আসবাবপত্র, ওষুধসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে গেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চুরির বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। তবে চুরির পর ওষুধ সরবরাহ করা হলেও যন্ত্রপাতি এখানো দেয়া হয়নি। তবে যে সকল যন্ত্রপাতি খুবই প্রয়োজন তা তিনি নিজে থেকেই কিনে নিয়েছেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে আবারো চুরির আশঙ্ক জানালেন তিনি। ওষুধ না দেবার কথা জানতে চাওয়া হলে তিনি জাগো নিউজকে জানান, যাদের ওষুধ প্রয়োজন নাই, তারাও ওষুধ চায়। না দিলেই তারা এ সকল অভিযোগ করেন। যাদের ওষুধ প্রয়োজন তাদের ওষুধ নিয়মিত প্রদান করা হয় বলে তিনি জানান। ক্লিনিকের সভাপতি ও ওয়ার্ড মেম্বর শহিদুল আলম শেখ জাগো নিউজকে জানান, ক্লিনিকে প্রবেশের রাস্তার কাজ খুব দ্রুতই শুরু করা হবে। ইউপি চেয়ারম্যান ইতোমধ্যে এই রাস্তার কাজের সব ব্যবস্থা করেছেন। শ্রমিক নিয়োগ প্রদান করে আগামী এক মাসের মধ্যেই রাস্তার কাজ শেষ করা হবে। চুরির বিষয়ে তিনি বলেন, ক্লিনিকটি একটি জনশুন্য এলাকায় হওয়ায় চুরি হয়েছে। এ বিষয়ে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন আর এখানে চুরির ঘটনা না ঘটে গ্রামবাসী তা দেখবেন বলে জানিয়েছেন। একজন নৈশপ্রহরীর ব্যবস্থা করা হলে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে। তবে নৈশ প্রহরী নিয়োগের ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষকেই করতে হবে। এছাড়াও ক্লিনিকের বিদ্যুতের সমস্যার সমাধানের জন্য একটি সোলার বিদ্যুৎ প্লান্ট প্রদান করা হয়েছে। যা চিকিৎসা সেবা উন্নয়নে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখছে। জেলা সিভিল সার্জন ডা. দেবপ্রদ রায় জাগো নিউজকে জানান, জেলার প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো ভালোভাবেই গরীব মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আসছে। প্রতিনিয়ত ক্লিনিকগুলো মনিটরিং করা হয়ে থাকে। এখানো পর্যন্ত কোনো অভিযোগ তিনি পাননি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ওষুধের কোনো অভাব নেই। চাহিদা মতো ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে আগের তুলনায় চাহিদার পরিমাণ বেড়ে গেছে। তাতেও কোনো অসুবিধা নেই, কারণ প্রচুর ওষুধ মজুদ রয়েছে। এমজেড/পিআর

Advertisement