বিশেষ প্রতিবেদন

হাতিরঝিলে দূষিত পানি : প্রশান্তির পরিবর্তে ভোগান্তি

রাজধানীর দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল প্রতিদিন হাজার-হাজার দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখরিত হয়। আর ছুটির দিনে তো রীতিমতো বিভিন্ন বয়সী মানুষের ঢল নামে এই ঝিলে। ইট-পাথরের এই যান্ত্রিক নগরীতে একটু প্রশান্তি পেতে দর্শনার্থীরা ভিড় জমান হাতিরঝিলে। কিন্তু নান্দনিক এ স্থান এখনও দর্শন উপযোগী হয়নি।হাতিরঝিলের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জাগো নিউজে থাকছে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ প্রথম পর্বে হাতিরঝিলের পানির দুর্গন্ধ নিয়ে থাকছে মানিক মিয়াজীর বিশেষ প্রতিবেদন।কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি দূর করতে এবং একটু আনন্দ পেতে অনেকে হাতিরঝিলে ঘুরতে যান। কিন্তু দৃষ্টিনন্দন এ স্থানের দুর্গন্ধযুক্ত পানির কারণে উল্টো ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে ভ্রমণপিপাসুদের। সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে স্লুইস গেট দিয়ে হাতিরঝিলে স্রোতের বেগে ঢুকে পয়োবর্জ্য মিশ্রিত পানি। এমন চিত্র যেন প্রতিদিনের। এতে হাতিরঝিলের পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। লেকের এ অংশের আশপাশের ওয়ার্কওয়েতে (হাঁটার পথ) নাকে রুমাল চেপে চলাচল করতে হয় দর্শনার্থীদের। এছাড়া আশপাশের বাসিন্দাদের দুর্ভোগের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।সরেজমিন হাতিরঝিল লেকের বিভিন্ন অংশ ঘুরেও লেকের পানির উৎকট দুর্গন্ধ অনুভূত হয়েছে। গত প্রায় ৭ বছরেও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়নি স্থানটি। দূর হয়নি গন্ধ। অবকাঠামো হলেও যেন আগের দুর্গন্ধময় হাতিরঝিলই রয়ে গেছে। সোনারগাঁও, মগবাজার, মধুবাগ, রামপুরা, গুলশান, বাড্ডা অংশের দুইপাশ দিয়ে বৃষ্টির পানি এবং ওয়াসার পানি প্রবেশ করে ঝিলের পানিকে করে তুলছে উৎকট দুর্গন্ধে।হাতিরঝিল সূত্রে জানা যায়, বর্ষার শুরুতেই বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য হাতিরঝিলের স্লুইস গেট খুলে দেয়া হয়। পুরো বর্ষায় কাঁঠালবাগান, কারওয়ান বাজার, মগবাজার, মধুবাগ, রামপুরা, গুলশান, বাড্ডা এলাকার বৃষ্টির পানি ওয়াসার ড্রেনের মাধ্যমে হাতিরঝিলে প্রবেশ করেছে। সূত্র জানায়, ঢাকা ওয়াসার পানি ও পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন ড্রেন দুটি এক হয়ে যাবার কারণেই মূলত হাতিরঝিলের পানিতে তৈরি হয়েছে দুর্গন্ধ।দর্শনার্থীরা জানান, হাতিরঝিলে চলছে চরম অব্যবস্থাপনা। এই সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য লাগানো গাছ ও ফুলেরও যত্ন নেয়া হচ্ছে না। জানা গেছে, ২০০৭ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের বয়স আট বছর অতিবাহিত হলেও প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পটি এখনও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। শেষ হয়নি অবৈধ স্থাপনা অপসারণ, জমি অধিগ্রহণ। ধীরগতিতে চলছে উন্নয়ন কার্যক্রম। প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের আড়াই বছর অতিবাহিত হলেও এখনও চালু হয়নি ওয়াটার বাস বা সড়ক পথের কোনো যানবাহন। হাতিরঝিলের প্রবেশপথ রামপুরা ও বাড্ডা এলাকার যানজট নিরসনে প্রকল্পের নকশায় ছিল দুটি ইউলুপ (গাড়ি পারাপারের উড়াল সড়ক)। রামপুরা অংশের ইউলুপের কাজ চললেও বাড্ডার অংশের ইউলুপের জমি অধিগ্রহণই এখনও শেষ হয়নি। কবে নাগাদ জমি অধিগ্রহণ হবে তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।হাতিরঝিল ঘুরে দেখা গেছে, লেকের বিভিন্ন অংশের প্রায় সবগুলো ডাস্টবিন চুরি হয়েছে। আর এ জন্যই যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ওয়াকওয়েতে (হাটার রাস্তায়)। এছাড়া পানির বোতল ও ময়লা কাপড়সহ নানা আবর্জনা ভাসছে লেকের পানিতে। ভাসমান দোকানপাট এ লেকে নিষিদ্ধ হলেও বাদাম, সিগারেটসহ অন্যান্য খাবার বিক্রির কারণে ময়লা-আবর্জনায় এ ঝিলের পরিবেশ দিন-দিন নষ্ট হচ্ছে।দূষণরোধে আট বছরেও তৈরি হয়নি পয়োশোধনাগার, আলাদা করা হয়নি বর্জ্য ও বৃষ্টির পানি প্রবেশের পথ। সংশ্লিষ্ট কর্মকতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বালু নদের কাছে দাসেরকান্দি পয়োশোধনাগার গড়ে না তোলা, বর্জ্য ও বৃষ্টির পানির প্রবাহ আলাদা না করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা, প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ ও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া বিষয়গুলো প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ না করার জন্য বাধা হিসেবে দেখছে তারা।২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা এ প্রকল্পটিতে অব্যবস্থাপনা ও দুর্গন্ধের বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন দর্শনার্থীরা।পরিবার নিয়ে গত শুক্রবার ঘুরতে এসেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী তানভীরুল আহমেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, পেশাগত কারণে তাকে থাকতে হয় সিলেটে। ছুটির সুযোগ নিয়ে পরিবারকে নিয়ে ঢাকায় ঘুরতে এসেছেন। হাতিরঝিলের কথা শুনেছেন। তাই ঘুরতে এসেছেন। কিন্তু এতো সুন্দর জায়গায় এতো গন্ধ চিন্তা করা যায় না।  বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, খুবই দুর্ভাগ্য যে চারপাশের পয়োবর্জ্য, গৃহস্থালি ও শিল্প-বাণিজ্যের বর্জ্য হাতিরঝিলের পরিবেশকে নষ্ট করে তুলছে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাতিঝেলের প্রকল্প পরিচালক জামাল আখতার ভূঁইয়া বলেন, হাতিরঝিলের কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। কাজ শেষ হতে আরও কিছু সময় লাগবে। আর ওয়াসার পানির বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, যত দ্রুত সম্ভব হাতিরঝিলের দূষণ বন্ধের চেষ্টা করা হবে।এএম/একে/পিআর

Advertisement