বিশেষ প্রতিবেদন

বিএনপির বোঝা ২০ দল!

নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সম্প্রসারিত হয়ে ১৮ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে এটি ২০ দলীয় জোটে উন্নীত হয়। এভাবে দল ভারী করে জোটের যে যাত্রা সেই জোট আজ জোটপ্রধান বিএনপির সম্পদ নাকি বোঝা, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

Advertisement

২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে যে জোটের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস সুদৃঢ় হয়েছিল তা ক্রমান্বয়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। ওই নির্বাচনের পর ১৮ দলীয় জোটের কাজী জাফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এবং সাম্যবাদী দলের একাংশ যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। এরপর তা বেড়ে ২৩ দলীয় জোটে উন্নীত হয়। তার পরই শুরু হয় নানা সন্দেহ আর অবিশ্বাস। শুরু হয় জোটত্যাগ এবং জোটত্যাগী দলের তৃতীয় বা চতুর্থ সারির নেতাদের দিয়ে রাতারাতি নতুন নতুন দল জন্ম দেয়ার প্রবণতা।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর প্রথম জোট ত্যাগ করে শেখ আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ-ভাসানী। জোটের সংখ্যা ঠিক রাখতে বিএনপি মহাসচিব রাতারাতি বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির গাইবান্ধা জেলার সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলামকে দিয়ে ন্যাপ-ভাসানীর জন্ম দেন। নতুন এ দলের জন্মের পেছনে জোটের দু-একজন শরিক দলের নেতারও ইন্ধন ছিল বলে জানা যায়। এমনও দেখা গেছে, নিজে দল না করলেও সেই দলেরই চেয়ারম্যান হয়েন তিনি।

‘২০১৪ সালের নির্বাচনে না যাওয়া ভুল ছিল’— এমন বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টি- এনপিপি চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নিলুর সঙ্গে জোট নেতাদের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জোট ত্যাগ করতে বাধ্য হন শেখ শওকত হোসেন নিলু। জোট ত্যাগের বিষয়ে তিনি সবসময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দায়ী করে আসছেন। নিলুর চলে যাওয়ার পরপরই নতুন এনপিপি গঠন করে জোটের সংখ্যা ঠিক রাখা হয়। যদিও সূত্র থেকে জানা যায়, নিলু বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় বিএনপি মহাসচিবের বাসায় এনপিপি ভাঙা নিয়ে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় ওই ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা রসাত্মক গল্প চালু হয়।

Advertisement

বিএনপির দীর্ঘদিনের বন্ধু ইসলামী ঐক্যজোটও শেষমেশ ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে। ঠিক একইভাবে রাতারাতি বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে বসে নতুন ইসলামী ঐক্যজোট গঠন করা হয়।

সূত্র মতে, এই মুহূর্তে জোটে ২৩টি দল দৃশ্যমান। দলগুলো হলো- ১. বিএনপি, ২. জামায়াতে ইসলামী, ৩. লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এলডিপি (অলি), ৪. বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ৫. খেলাফত মজলিস, ৬. জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা, খন্দকার লুৎফর রহমানের অংশ), ৭. জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা, ব্যারিস্টার তাসমিয়া), ৮. ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এনডিপি (ভগ্নাংশ), ৯. ন্যাশনাল পিপলস পার্টি- এনপিপি (ভগ্নাংশ), ১০. ইসলামি ঐক্যজোট (অস্তিত্বহীন), ১১. বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি (অস্তিত্বহীন), ১২. বাংলাদেশ মুসলীম লীগ (অস্তিত্বহীন), ১৩. ডেমোক্রেটিক লীগ (দলের প্রতিষ্ঠাতা অলি আহমদের মেয়ে), ১৪. সাম্যবাদী দল (যার সাধারণ সম্পাদক ২০০৮ সালের পর বিদেশে অবস্থান করছেন), ১৫. বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- বাংলাদেশ ন্যাপ (ভগ্নাংশ, যার নেতা মূল দলের ঢাকা মহানগরীর একজন সম্পাদক ছিলেন মাত্র), ১৬. ন্যাপ (ভাসানী, ভগ্নাংশ) ১৭. জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), ১৮. জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (কাসেমী), ১৯. জমিয়তে উলামায়ে (ওয়াক্কাস), ২০. বাংলাদেশ জাতীয় দল, ২১. বাংলাদেশ লেবার পার্টি (ভগ্নাংশ), ২২. পিপলস লীগ এবং ২৩. লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এলডিপি (শাহাদাত)।

সংশ্লিষ্টদের মতে, জেবেল রহমান গাণি ও এম গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ন্যাপের নিবন্ধিত অংশ জোট ত্যাগ করলে তাদের মহানগর পর্যায়ের নেতা শাওন সাদেকীকে ন্যাপ সভাপতি করে জোটে রাখা হয়। এছাড়া ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এনডিপি চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা জোট ত্যাগের পর ক্বারী আবু তাহের নামের একজনকে এনডিপির চেয়ারম্যান করে জোড়াতালি দিয়ে জোট টিকিয়ে রাখে বিএনপি

জোট সংশ্লিষ্টরা জানান, যারা জোট ত্যাগ করেছেন তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা সেভাবে না থাকলেও রাজনীতিতে বেশ পরিচিতি ছিল, ছিল অভিজ্ঞতার ঝুলিও। কিন্তু তারা চলে যাওয়ার পর বিকল্প হিসেবে যাদের জোটে রাখা হয়েছে তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা তো দূরের কথা, অভিজ্ঞতার পর্যন্ত ঘাটতি রয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষ বলা হয়, এসব নেতা তাদের স্ত্রী-পরিবার ছাড়া কারও কাছেই পরিচিত নন।

Advertisement

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম [ফাইল ছবি]

সর্বশেষ ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ। জোট ত্যাগের বিষয়ে তিনিও মির্জা ফখরুলের ওপর দায় চাপান। বিজেপি মনে করে, নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে পরে নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট ৩০ ডিসেম্বরের প্রহসনের নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। এমন অবস্থায় ২০ দলীয় জোটের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিজেপির ২০ দলীয় জোটের সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত যৌক্তিক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ২০ দলীয় জোটের এক শীর্ষ নেতা জাগো নিউজকে বলেন, মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নাতি ও সাবেক মন্ত্রী শফিকুল গনি স্বপনের পুত্র জেবেল রহমান গাণির বিকল্প হিসেবে তার দলের সর্বশেষ বেঞ্চের একজন কর্মী, যে কিনা পাসপোর্ট জালিয়াতের সঙ্গে জড়িত বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, তেমন একজন ‘টোকাই’ শাওন সাদেকীকে নেতা বানানো বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আবার তাদের সঙ্গে নিয়ে বিএনপির মতো একটি বড় দলের শীর্ষ নেতারা কী করে বৈঠক করেন?

অন্যদিকে রাতারাতি বিএনপির দুই অংশের প্রতিযোগিতায় খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার এনডিপিও ভেঙে জন্ম নেয় দুটি দলে। একটি মোকাদ্দেম হোসেনের নেতৃত্বে আরেকটি ক্বারী আবু তাহেরের নেতৃত্বে। যদিও শেষ পর্যন্ত মোকাদ্দেম পরাজিত হয়ে পিছু হটেন আর তাহের এনডিপির চেয়ারম্যান হিসেবে ২০ দলে প্রবেশ করেন।

সূত্র জানায়, মানবপাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত ক্বারী আবু তাহের একজন পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত। তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর হয়ে বিভিন্ন কাজ করেন। তাহেরকে জোটের নেতা বানাতে সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষকতা করেন আবদুল আউয়াল মিন্টু ও বিএনপির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু।

এ বিষয়ে ২০ দলীয় জোটের ওই শীর্ষ নেতা বলেন, পুলিশের একজন সোর্স ২০ দলের বৈঠকে অংশগ্রহণ করে, তারপরও বিএনপির নেতারা কী করে মনে করেন যে, তাদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত গোপন থাকবে? ১/১১-এর সময় যারা মইনুদ্দিন আহমেদের আশ্রয়ে নিরাপদ ছিলেন তারাই ক্বারী তাহেরদের মতো লোককে নেতা বানাতে পারেন। মূলত এভাবেই জোড়াতালি দিয়ে জোট টিকিয়ে রাখা হয়েছে।

জোটের অন্যতম উদ্যোক্তা শফিউল আলম প্রধান প্রয়াত হওয়ার পর জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা সভাপতি ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান জোটের কার্যক্রম থেকে দূরে সরে যান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে বিষোদগারও করেন। ফলে জাগপায়ও ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এই ভাঙনের পেছনে বিএনপি মহাসচিবের সুস্পষ্ট ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করেন তাসমিয়াপন্থীরা। এছাড়া খন্দকার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বাধীন জাগপা ভাঙার পেছনে নেপথ্যের নায়ক হিসেবে আছে বিএনপির একটি অংশ।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি শরিক দল নিয়ে গঠন করেন ‘জাতীয় মুক্তিমঞ্চ’। মুক্তিমঞ্চের মূল নেতা অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপিও ভাঙনের শিকার হয়। এই ভাঙনের পেছনে অলি ও তার সমর্থকরা বিএনপিকে দায়ী করেন। এক্ষেত্রে তাদের অভিযোগের তীর বিএনপির এক শীর্ষ নেতার দিকে।

অন্যদিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতির রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের বিষয়টি বারবার সামনে চলে আসছে। বিদেশে বিএনপির বন্ধু শক্তিরা বারবার জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের চাপ দিচ্ছে। এমনও শোনা যাচ্ছে, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করতে পারছে না বিএনপি

২০ দল ও ঐক্যফ্রন্টের সংবাদ সম্মেলন [ফাইল ছবি]

সবকিছু মিলিয়ে ২০ দলীয় জোট এখন আর বিএনপির সম্পদ নয় উল্টো বোঝায় পরিণত হয়েছে। এই বোঝা অপসারণে দলটির মধ্যে আলোচনা চলছে বলে জানা যায়।

এ প্রসঙ্গে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে দেশে কর্তৃত্ববাদী একদলীয় ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা চলছে। এটা থেকে পরিত্রাণের জন্য গণতন্ত্র ও দেশের মানুষের ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য এই জালিম শাহীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে বৃহত্তর ঐক্য এখন অপরিহার্য।

‘এই মুহূর্তে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে হয়তো বা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও আমি মনে করি, বাংলাদেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপির ২০ দলীয় জোট তথা এটাকে যদি আরও সম্প্রসারণ করে একটি বৃহত্তর ঐক্য করা যায় সেটা কখনওই বিএনপির জন্য বোঝা হবে না।’

তিনি বলেন, ২০ দলীয় জোটকে আরও সুসংহত এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলেই স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারের পতন নিশ্চিত করতে হবে। কিছু কিছু মিডিয়া ও ষড়যন্ত্রকারী বর্তমান প্রেক্ষাপট কাজে লাগিয়ে ২০ দলীয় জোটের মধ্যে অনাস্থা ও অনৈক্য সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বলেই আমি বিশ্বাস করি।

জোটের আরেক শরিক ন্যাপ-ভাসানীর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলামের দাবি, জোটের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। কোনো দূরত্বও নেই। বিএনপি সাম্প্রতিক সময়ে যে উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তা জোটের শরিকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল আলোচনা করেই নিয়েছে।

কেএইচ/এমএআর/পিআর