বিশেষ প্রতিবেদন

কমিউনিটি ক্লিনিকের সুফল পাচ্ছে নওগাঁর মানুষ

কমিউনিটি ক্লিনিকের সুফল ভোগ করছে নওগাঁর মানুষ। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ এখন হাতের কাছে স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন। বেশির ভাগই হতদরিদ্র ও গরিব শ্রেণির মানুষরাই কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নিতে আসেন। সেবার পাশাপাশি বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে সরকারি ওষুধ। কমিউনিটি ক্লিনিক গ্রামের মানুষের কাছে হাসপাতাল নামে পরিচিত। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইসসিপি) ছাড়া  ডাক্তারদের ক্লিনিকে পাওয়া যায়না বলে বলে জানান স্থানীয়রা। কমিউনিটি ক্লিনিক যেন বন্ধ না হয় এবং বেশি করে ওষুধ সরবরাহ করা হয় এ জন্য সরকারের দৃষ্টি আর্কষণ করেছেন এলাকাবাসী।সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, গ্রামের হতদরিদ্র জনগণের স্বাস্থ্যসেবার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকে সপ্তাহে দুইদিন করে একজন উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার, সপ্তাহে ৬ দিন বসেন একজন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার এবং তিন দিন বসেন স্বাস্থ্য সহকারী (এইচএ) ও তিন দিন করে বসেন পরিবার কল্যাণ সহকারী। ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। সে অনুসারে নওগাঁর ১১ উপজলায় আছে ৩০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক। এসব ক্লিনিকে ছুটির দিন ব্যতীত সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সেবা দেয়া হয়। স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা ছাড়া ও ইপিআই কর্মসূচির সকল কার্যক্রম এসব কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে বাস্তবায়ন করা হয়।কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইসসিপি) সাথে কথা বলে জানা গেছে, একটি কার্টুনে ৩০ পদের ওষুধ দুই মাসের জন্য নির্ধারণ করা থাকে। প্রতিমাসে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ১৫০০ পিস, এন্টাসিড ১২৫০ পিস, হিস্টাসিন ৫০০ পিস, এ্যামক্সসিলিন ২৫০ পিস, কট্রিম ৫০ পিমস, প্যারাসিটামল সিরাপ ২৪ পিস, মলম ৫০০গ্রাম এবং চোখের ড্রপ ১০পিস। সাধারণত জ্বর, সর্দি, কাশি ও এলার্জি রোগীর সংখ্যাই বেশি। আর এ ওষুধগুলো বেশি ব্যবহৃত হয়। এসব রোগের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সিপলোসিন বেশি লাগে। তাই এ ধরনের ওষুধের চাহিদা বাড়ানো দরকার।এছাড়া চাকরি রাজস্ব খাতে না হওয়ায় কর্মঠ ও দক্ষ সিএইসসিপিরা চাকরি ছেড়ে অনত্র চলে যাচ্ছে। যাতে মেধাশূন্য ও দক্ষ কর্মী হারাচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। চাকরি দ্রুত রাজস্ব না করলে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ার আশাংকা প্রবল হয়ে উঠেছে। সিএইসসিপিদের প্রকল্পের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে হয়। এ চাকরি রাজস্ব খাতে নেয়া হলে ডাক্তার, স্বাস্থ্য সহকারী (এইচএ), পরিবার কল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ) রা নিয়মিত ক্লিনিকে আসবেন। চাকরি রাজস্ব না হওয়া এইসব কর্মকর্তা ক্লিনিকে না এসে সিএইসসিপিদের দিয়েই খাতায় উপস্থিতি স্বাক্ষর করানো হয় বলেও জানা গেছে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সিএইসসিপি জানান, আমরাই একমাত্র ক্লিনিকের ভরসা। যদিও ডাক্তার, স্বাস্থ্য সহকারী (এইচএ), পরিবার কল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ) দের ক্লিনিকে নিয়মিত আসার কথা থাকলেও তারা আসেন না। তাদের অনুপস্থিতিতে সবই করতে হয় আমাদের। মাস শেষে ক্লিনিকে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর এবং অগ্রিম স্বাক্ষরও করেন।সরজমিনে মঙ্গলবার নওগাঁ সদর উপজেলার কয়েকটি ক্লিনিক ঘুরে দেখ গেছে ক্লিনিকগুলোতে ওষুধ সংকট। উপজেলার কির্ত্তীপুর ইউনিয়নের শালেবাজ কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায় চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা বাইরে অপেক্ষা করছেন। আর ভিতরে সিএইসসিপি মোহাম্মদ হোসাইন মাসুদা (৩৫) নামে রোগীর পেশার দেখছেন। মাসুদা সর্দি, জ্বর ও এলার্জিতে ভুগছেন। ওষুধ না থাকায় তাকে প্যারাসিটামল দিয়ে বিদায় করে দিলেন। তিনি গতমাসে ৭৪৭জন রোগী দেখেছেন।ওইদিন সকাল ১০ টা ১৩ মিনিটে উপ-সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. তাসকিন জাহান ইথার ক্লিনিকের মধ্যে প্রবেশ করেন। সপ্তাহে ২দিন করে ক্লিনিকে আসার কথা থাকলে হাজিরা খাতায় দেখা যায় সেপ্টেম্বর মাসে ৫দিন এবং অক্টোবর মাসে ৫দিন স্বাক্ষর করা আছে।ওই ক্লিনিকের পরিবার কল্যাণ সহকারী মাকসুদা পরি জানান, তিনি নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা দেন এবং ওষুদের কোন সমস্যা নেই বলে জানান।কির্ত্তীপুর ইউনিয়নের জালম কমিউনিটি ক্লিনিকে দেখা যায় সিএইসসিপি চঞ্চল মাহমুদ দুই নারী রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। তিনি গত মাসে ৮৬৮ জন রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন। ওই ক্লিনিকে উপ-সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (স্যাকমো) ডা. শামিম আরা ২০১৫ সালে মার্চ মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইচ্ছেমত যান আর আসেন। হাজিরা খাতায় তিনি কোন স্বাক্ষর করেন না। ৩ মাসের ছুটিতে আছেন নভেম্বরে শেষের দিকে ছুটি শেষ হবে বলে জানান।চিকিৎসা নিতে আসা মুসলিমা সাথি (৩৫) সর্দি, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট সমস্যার চিকিৎসা নিতে এসেছেন। উপ-সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা চিকিৎসা দেয় কিনা জানতে চাইলে জানান তাকে কখন দেখেননি। সিএইসসিপিদের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে চলে যেতে হয়।নওগাঁ সদর উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের বাচাড়ীগ্রাম কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইসসিপি সাদ্দাম ইবনে মোস্তফা জানান, দুই মাস পরপর ওষুধ পাওয়া যায়। একটি কার্টুনে ৩০ পদের ওষুধ থাকে। চাহিদার তুলনায় সরকার শতকরা ২৫ ভাগ ওষুধ সরবরাহ করতে পারে। গত ৮ দিন থেকে ওষুধ না থাকায় রোগীরা এসে ফিরে যাচ্ছেন। আগামী ৬ নভেম্বর ওষুধ পাওয়া যাবে। গত অক্টোবরে ৬৩৪ জন রোগীকে সেবা দেন বলে জানান। তবে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওষুধ না থাকায় বয়স্ক দুই নারীকে ফিরে যেতে দেখা গেছে।নওগাঁ সদর উপজেলার বলিহার ইউনিয়নের নিন্দইন কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইসসিপি এসএম আবুজর গিফারী জানান, যে পরিমাণ ওষুধ দুই মাসের জন্য দেয়া হয় তা দেড় মাসেই শেষ হয়ে যায়। এজন্য প্রতিনিয়ত ওষুধ সংকট থাকে। অনেক রোগীর ওষুধ সরবরাহ করা সম্ভব হয়না। গত অক্টোবর মাসে গর্ভবতী, শিশু ও সাধারণ রোগীসহ ১ হাজার ৩০ জনকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন বলে জানান।চিকিৎসা নিতে আসা আঞ্জুমান আরা (৪৫) জানান, ওষুধ কম হওয়ায় চাহিদা মত পাইনা। এছাড়া বড় ডাক্তারাও আসেন না। শুধু সিএইসসিপি রাই থাকেন। তার কাছ থেকেই চিকিৎসা ও ওষুধ নেই।চিকিৎসা নিতে আসা ইয়নুছ আলী শাহনাজ জানান, এখন আর কষ্ট ও টাকা খরচ করে শহরের হাসপাতালে যেতে হয় না। যদি বড় ডাক্তাররা ক্লিনিকে নিয়মিত আসতো চিকিৎসা আরো ভাল হতো। সাধারণ রোগের চিকিৎসা আমরা এখান থেকেই নেই। ওষুধ নিতে টাকা দিতে হয় না। এছাড়া সরকার যেন বেশি বেশি করে ওষুধ সরবরাহ করে।নওগাঁ জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোজাহার হোসেন বুলবুল জানান, নওগাঁর ১১টি উপজেলায় ৩০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। জেলায় ২৯৮টিতে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইসসিপি) আছে। জেলার ধামইরহাট উপজেলার ইসবপুর ইউনিয়নের রাধামহন কমিউনিটি ক্লিনিক এবং পত্নীতলা উপজেলার পত্নীতলা ইউনিয়নের বালুঘা কমিউনিটি ক্লিনিকে সিএইসসিপির পদ শূন্য থাকায় স্বাস্থ্য সহকারী দিয়ে সেবার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। সবগুলোতে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে।ওষুধ সংকটের বিষয়ে তিনি জানান, এটি সরকারের বিষয়। সরকার যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয় কমিউনিটি ক্লিনিকে তা সরবরাহ করা হয়।এসএইচএস/পিআর

Advertisement