বিশেষ প্রতিবেদন

ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা পুরুষ মনে করে নারীকে ধর্ষণ করাই যায়!

অ্যাডভোকেট সালমা আলী। মানবাধিকার আইনজীবী। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক নির্বাহী প্রধান। নারীর অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। বিশেষ করে নারীপাচার রোধে এবং প্রবাসী নারী শ্রমিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখছেন এ মানবাধিকার নেত্রী।

Advertisement

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে ৯৭৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গণধর্ষণের ঘটনা ২০৮টি। এছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ৪৩টি। বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এমন তথ্যের ভিত্তিতে কথা হয় অ্যাডভোকেট সালমা আলীর সঙ্গে। করোনা মহামারির মধ্যেও নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে ‘আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা না থাকা’, সর্বোপরি ‘গণতন্ত্রহীন সমাজ ব্যবস্থাকেই’ দায়ী করেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : মহামারির সময়ও ধর্ষণের বীভৎসতা। নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছেই। এর বিশেষ কোনো ব্যাখ্যা আছে কি-না?

সালমা আলী : মূলত আইনের প্রয়োগ না থাকা এবং বিচারহীনতার কারণেই এমন সহিংসতা। এ কারণে নারী নির্যাতনের প্রবণতা বছরের পর বছর ধরে আমরা দেখে আসছি।

Advertisement

মহামারিকালেও ধর্ষণের যে চিত্র আমরা লক্ষ্য করছি, তার প্রথম কারণ হচ্ছে নজরদারির অভাব। বাসাবাড়িতে কী হচ্ছে, তার অনেকটাই আড়াল থেকে যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। অনেক বাবা-মা কন্যাদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। চাপে পড়ে বিয়ে করছে মেয়েরা, যেখানে (স্বামীর ঘরে) নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

আর নির্যাতনের অভিযোগে দোষীদের যে সাজা হওয়ার কথা, তা দৃশ্যমান নয়। এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে সমাজের যেভাবে এগিয়ে আসার কথা, তাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

জাগো নিউজ : সমাজ এগিয়ে না আসার কী কারণ থাকতে পারে?

সালমা আলী : এক্ষেত্রে সবার আগে দায়িত্বটা থাকে পরিবারের। পরিবার নিয়েই সমাজ। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক পরিবারগুলোতে নারীর প্রতি যে সম্মান থাকার কথা, তা থাকছে না। নারী যে ভোগ্যপণ্য, তা পরিবার থেকেই নির্ধারিত হয়। ফলে সমাজে নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা পুরুষের চোখেই প্রকাশ পায়।

Advertisement

স্বামীর কাছ থেকে একজন নারী মানুষ হিসেবে সম্মান পাচ্ছে না। ছেলে আর মেয়ের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করেন স্বয়ং বাবা-মা। এটি তো হাজার বছরের পুরানো চিত্র।

জাগো নিউজ : এমন চিত্রের মধ্যেও সভ্যতা এগিয়েছে। কিন্তু নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেন বদলাচ্ছে না?

সালমা আলী : ক্ষমতা। পুরুষ ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকছে। একজন যুবক বা তরুণ ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সেটা ছোট পরিসরে হলেও। এ ক্ষমতার কাছে নারী খুবই দুর্বল। শুধু শারীরিক দুর্বলতাই নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়াচ্ছে না। ক্ষমতাও দায়ী। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা পুরুষ মনে করে নারীকে ধর্ষণ করাই যায়!

ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে, পর্নোগ্রাফির বিকাশ। সবার হাতেই প্রযুক্তি, সবার হাতেই মোবাইল। সর্বত্র পর্নোগ্রাফিতে সয়লাব। এতে আসক্ত হয়ে যুবক, তরুণরা নারীর প্রতি সহিংস হয়ে উঠছে। বাড়ছে পর্নোগ্রাফি, বাড়েছে ধর্ষণও।

আমরা রিফাত হত্যার রায় দেখলাম। যারা এর সঙ্গে জড়িত তারা প্রায় কিশোর। নয়ন বন্ডরা একদিনে তৈরি হয়নি। তারা ক্ষমতার কাছে থেকে এমন সহিংস হয়ে উঠেছে। তাদের তৈরি করা হয়েছে। এমন লাখ লাখ যুবক নারীর জন্য হুমকির কারণ। সমাজ এখন ক্ষমতার কাছে জিম্মি।

জাগো নিউজ : এই ক্ষমতার প্রশ্নে গণতন্ত্র, ভোট, নির্বাচন, সুশাসনও আসে...

সালমা আলী : অবশ্যই। গণতন্ত্রহীন সমাজে চেইন অব কমান্ড থাকে না। দল, রাজনীতি, সরকার, রাষ্ট্র— সর্বত্রই জবাবদিহিতার অভাব। গণতন্ত্রহীন সমাজের যে চিত্র তারই বহিঃপ্রকাশ ধর্ষণকাণ্ডের বর্তমান চিত্র।

সিলেটের এমসি কলেজে যা ঘটল, তা তো ক্ষমতার কারণেই। একজন স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ! এটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। ধর্ষকরা একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় ক্ষমতা ধারণ করে। তারা মনে করে, আইন, পুলিশ কিছুই করতে পারবে না তাদের।

জাগো নিউজ : ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। পক্ষ-বিপক্ষে মত প্রকাশ পাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও। আপনার বিশ্লেষণ কী?

সালমা আলী : মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র সমাধান নয়। মৃত্যুদণ্ড তো দেয়া হচ্ছে অনেক অপরাধীকে। অপরাধ কি কমছে? বরং বেড়েই চলছে।

নারীর সুরক্ষায় যে আইন আছে, তা অনেক শক্তিশালী। বাংলাদেশের সংবিধানেও নারীর অধিকার যথাযথভাবে সংরক্ষণ আছে। সমস্যা হচ্ছে, আইনের প্রয়োগ এবং আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা না থাকা।

সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, সচেতনতার অভাব। পুরুষ বা নারীর নিজের প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ বা সম্মান দেখানোর কথা, তা ক্রমশই লোপ পাচ্ছে। সমাজ-সচেতন না থাকার কারণেই নারী সর্বক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

আমি মনে করি, ক্ষমতায়নের প্রশ্নে ভারসাম্য আনতে না পারলে নারীর প্রতি নির্যাতন কমবে না। এ ক্ষমতা পরিবার থেকে শুরু করে রাজনীতির মাঠেও নিশ্চিত করতে হবে। নারীকে উপার্জনের পথে সমান তালে হাঁটার সুযোগে করে দিতে হবে।

জাগো নিউজ : উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনায় উত্তপ্ত গোটা ভারত। এর আগেও ভারতে এমন প্রতিবাদ লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন প্রতিবাদে মাঠে নেই নাগরিক সমাজ...

সালমা আলী : বাংলাদেশে প্রতিবাদ একেবারেই যে হচ্ছে না, আমি তা বলব না। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার প্রতিবাদে নাগরিকরা কিন্তু মাঠে নেমেছিলেন। ইয়াসমিন হত্যাকাণ্ডের পর আমরা সরব আন্দোলন করেছিলাম। আমি তখন বেইজিংয়ে ছিলাম। বিশ্ব মিডিয়া আমাদের আন্দোলন গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করে।

আমরা নারীরা প্রতিবাদ করছি। কিন্তু পুরুষ বা গোটা সমাজকে যেভাবে পাশে পাবার কথা, তা কিন্তু পাচ্ছি না। বিভাজন সর্বত্রই। আপনি দেখবেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোও বক্তব্য দিয়ে দায় সারছে। তাদের মাঠে দেখতে পাই না।

কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী যেভাবে মাঠে নেমে গেলেন, এখানে এমন দেখতে পাবেন? শুধুই কাদা ছোড়াছুড়ি। সমাজে অস্থিরতার জন্য রাজনীতিই প্রধানত দায়ী।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু বিজয়ী হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করলেন। দেশ স্বাধীন হলো। সেই বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কি এমন রাজনীতি চেয়েছিলেন? জবাবদিহিতা তো কোথাও নেই। আমাদের চাপের কারণে ভালো ভালো আইন হয়েছে। কিন্তু প্রয়োগ করবে কে? কার ওপর মানুষের আস্থা আছে? পরিবেশ কি আছে?

জাগো নিউজ : নারীর ভবিষ্যৎ তাহলে কী?

সালমা আলী : নারীর জন্য চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে সামনে। এ কারণেই আমি বারবার বলছি, নারীকেই সচেতন হতে হবে সবার আগে। নারীর অধিকার নারী রক্ষা করতে না পারলে পুরুষ করে দেবে না। নারীর ভবিষ্যৎ নারীকেই গড়ে নিতে হবে।

এএসএস/এমএআর/জেআইএম