ফিচার

গ্রামীণ সমাজে কোণঠাসা ‘নারী’

মামুন সোহাগ

Advertisement

বাংলাদেশের সমাজ জীবনে অন্যতম একটি শব্দ নারী। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রায় শতাব্দীকাল আগেই বলে গেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ বিশেষভাবে বাংলাদেশের জন্য নর-নারীর সমঅধিকার বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

পুরুষের কাজের পাশাপাশি নারীরাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারী তার সব সামর্থ্য প্রয়োগ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরিতে। ১৯৭১ সালে জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন অগণিত বাঙালি নারী। অথচ আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর অবদান সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। আমাদের সমাজে নারীর প্রতি পরিপূর্ণভাবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠেনি।

গ্রামে নারী গৃহস্থালি, কৃষি ও পশু পালনের মতো উৎপাদন–কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তার স্বীকৃতি নেই। শহরেও নারীর গৃহস্থালি কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। নারীর অবদান একমাত্র লাঞ্ছিত ও ধর্ষিত হওয়ার মধ্যেই নির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ধর্ষণ, নিপীড়ন থেকে নারীদের সহায়তায় তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রায়ই গণপরিবহনসহ বিভিন্ন স্থানে ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। সম্প্রতি সিলেটের এমসি কলেজে গৃহবধূ এবং খাগড়াছড়িতে এক প্রতিবন্ধীকে দলগত ধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় চলছে।

Advertisement

পৃথিবী, প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষ ও মানবসভ্যতা আজ বিপন্ন। পশু, পাখি, জমি, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা ও বাণিজ্য সবকিছুই বিপন্ন। এসব বিপন্নতার কারণ প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সন্ত্রাস, যুদ্ধ ইত্যাদি।

কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারী যখন বিপন্ন হচ্ছে, তখন বিশ্লেষণে জানা যায়, ‘নারী’ বলেই সে বিপন্ন। নারী নিপীড়ন বিভিন্ন ধরনের। কিন্তু সব নিপীড়নেরই কারণ একটি: লিঙ্গ পরিচয়ে সে নারী; তাই নির্যাতিত। প্রচলিত সামাজিক বিশ্বাস ও কুসংস্কার নারীকে লিঙ্গীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ রেখে প্রমাণ করতে চায়, নারী মানুষ নয়।

নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা লিঙ্গগত হলেও পুরোপুরি সমাজ আরোপিত। সমাজ পরিবর্তনের জন্য নারীর সংগ্রাম তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশে নারীরা শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে গেছে যদিও গ্রামীণ সমাজে এখনো মেয়েরা লেখাপড়া ছেড়ে দিচ্ছে এবং শিখছে ঘর-সংসারের কাজ। এদেশের গ্রামীণ সমাজে এখনো অল্প বয়সে মেয়েদের অভিভাবক তাদের বিয়ে দিয়ে দেয় তাদের প্রকৃত সম্মতিকে উপেক্ষা করেই এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রীতি অনুযায়ী মেয়েদের পালন করতে হয় প্রথাগত ঘর-সংসারের দায়িত্ব। যদিও বাল্যবিবাহের হার আগের চেয়ে অনেকটা কমে এসেছে।

শিক্ষিত মেয়েরা যেমন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে মেধা ও শ্রম দিয়ে সাহসিকতার সাথে কাজ করছেন। ঠিক সেভাবেই গ্রামের নারীরাও সর্ব শক্তি দিয়ে পুুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছেন রাতদিন। বাসা-বাড়িতে, মাঠে-ঘাটে ও কৃষি জমিসহ সর্বত্র। পার্থক্যটা শুধু এখানেই, শহরের নারীরা কিছুটা আত্মমর্যাদা ও সম্মান পেলেও গ্রামবাংলার নারীরা আজও অবহেলিত বিভিন্নভাবে। শহরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীরা তার প্রাপ্য মর্যাদা বুঝে নিলেও পারছেন না গ্রামীণ নারীরা। তারা বাসা-বাড়িতে কঠোর পরিশ্রম করেন, সে কাজের কোনো স্বীকৃতি তো মেলেই না, পান না কোন মজুরিও। উল্টো শুনতে হয় নানা অসম্মানজনক কথা।

Advertisement

বাংলাদেশের নারী আন্দোলন-সংগ্রামের অবিসংবাদী নেত্রী রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) বলেছেন, ‘আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং নারীর স্বার্থ ভিন্ন নহে—একই। জগতের যে সকল সমাজের পুরুষেরা সঙ্গিনীসহ অগ্রসর হইতেছেন, তাঁহারা উন্নতির চরমসীমায় উপনীত হইতে চলিয়াছেন। আমাদের উচিত যে, তাহাদের সংসারের এক গুরুতর বোঝাবিশেষ না হইয়া আমরা সহচরী সহকর্মিনী সহধর্মিণী ইত্যাদি হইয়া তাহাদের সহায়তা করি।’

গ্রামীণ নারী ও পুরুষের ওপর করা ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২ দশমিক ১টি কাজে ব্যয় করেন ৭ দশমিক ৭ ঘণ্টা। পুরুষ ২ দশমিক ৭টিতে করেন ২ দশমিক ৫ ঘণ্টা। অর্থাৎ পুরুষের তুলনায় নারী ৩ গুণ কাজ করেন। তাই নারীদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো এখন সময়ের দাবি। গ্রামীণ নারীদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে আসতে হবে। তাহলেই ভেদাভেদ দূর করে সমতা বিধান করা সম্ভব হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী।

এসইউ/এএ/এমএস