বিশেষ প্রতিবেদন

মোমের আলোয় চলছে বরগুনার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো

এক সময়ের ঝিমিয়ে পড়া কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো হঠাৎই যেন জেগে উঠেছে বরগুনায়। তৃণমূল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবার লক্ষ্যে নিভৃত গ্রামাঞ্চলে গড়ে তোলা বরগুনার ১১৬টি কমিউনিটি ক্লিনিকের অধিকাংশই স্থানীয়দের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,স্থানীয়দের সহযোগিতায় এসব ক্লিনিকের মধ্যে বেশ কিছু ক্লিনিকেই চালু করা হয়েছে প্রসূতি সেবা কেন্দ্র। সেখানে প্রসূতি মায়েদের নিরাপদ প্রসবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেবা দেয়া হচ্ছে।অন্যদিকে নিভৃত গ্রামের এসব ক্লিনিকগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ এবং সংযোগ সড়ক না থাকায় প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি ঝড়বৃষ্টির সময় ব্যাহত হয় সেবা কার্য্যক্রম। বিদ্যুৎ না থাকায় প্রতিটি ক্লিনিকের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত ল্যাপটপও যথাযথভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। এমন সমস্যার কথা উল্লেখ করে এসব ক্লিনিকগুলো যেখানে স্থাপন করা হয়েছে সেসব এলাকাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুতায়নের আওতায় নেয়ার দাবি জানিয়েছেন সুবিধাভোগী স্থানীয় অধিবাসীরা। পাশাপাশি এসব ক্লিনিকে কর্মরত স্বাস্থ্য সেবকদের সরাসরি সরকারিকরণের দাবিও জানিয়েছেন তারা।বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের কাঠালতলী কমিউনিটি ক্লিনিকে সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, নারী ও শিশুসহ প্রতিদিন গড়ে ৩৫-৪০ জন রোগী আসছেন এ ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় নিভৃত গ্রামের গাছ-গাছালি আচ্ছন্ন এ ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা এসব রোগী অন্ধকারে বসে চিকিৎসা সেবাসহ স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ দেন এই ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সহকারী মো. রিয়াজুল কবীর রিয়াজ এবং কমিউনিটি হেলথ্ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) মোসা. নুসরাত জাহান।এই কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্য সহকারী এবং কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারের (সিএইচসিপি) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয়দের সহযোগিতায় সম্প্রতি সেখানে খোলা হয়েছে প্রসূতি সেবা কেন্দ্র। প্রতিদিন না হলেও মাসে গড়ে পাঁচ-সাতজন প্রসূতি মা এখানে নিরাপদ প্রসূতি সেবা নিচ্ছেন। নিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি পরামর্শও।এ ক্লিনিক থেকে সম্প্রতি প্রসূতি সেবা নিয়ে এখন সুস্থ আছেন কাঠালতলী গ্রামের দরিদ্র গৃহবধূ সালমা বেগম। তিনি জাগো নিউজকে জানান, একে তো দরীদ্র পরিবারের অভাবি সংসার। তার উপরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়ি তার। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় প্রসূতি সেবা নিতে শহরে যাওয়া তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিলো। এমন সময় তার এক প্রতিবেশির পরামর্শে এই ক্লিনিকে সেবা নিতে আসেন তিনি।তিনি আরো জানান, গত একমাস আগে তিনি একটি কন্যা সন্তাদের মা হয়েছেন। এসময় তিনি কাঠালতলী কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্য সহকারী মো. রিয়াজুল কবীর রিয়াজ এবং কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) মোসা. নুসরাত জাহানের প্রসংশা করে বলেন, তাদের প্রসূতি সেবা এবং প্রসব পরবর্তী সেবা ও পরামর্শ নিয়ে তিনি ও তার সন্তান এখন সুস্থ আছেন। কাঠালতলী কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সহকারী মো. রিয়াজুল কবীর রিয়াজ জাগো নিউজকে জানান, রাস্তা থেকে ক্লিনিকে যাওয়ার সংযোগ সড়ক এবং বিদ্যুৎ না থাকায় সেবা কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হয়। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এই ক্লিনিক সেবা নিতে আসা রোগীরা বেশি ভোগান্তির শিকার হন। বৃষ্টির সময় ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা রোগীদের কাঁদা-মাটি পেড়িয়ে পিচ্ছিল পথ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে এ ক্লিনিকে আসেন। এছাড়াও বিদ্যুত না থাকায় বর্ষা মৌসুমে দিনের বেলায় মোম জ্বালিয়ে রোগীদের সেবা দিতে হয় বলেও জানান তিনি।এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুল হক স্বপন জাগো নিউজকে জানান, তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষে বর্তমান সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন একটি মহতী উদ্যোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন, তার ইউনিয়নে চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এই ক্লিনিকের কারণে তার এলাকার মানুষ বিনা টাকায় হাতের নাগালে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি। বরগুনার একাধিক কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি ব্যতিত প্রতিটি ক্লিনিক সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সপ্তাহে ছয়দিন বসেন একজন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) এবং তিনদিন করে বসেন একজন স্বাস্থ্য সহকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা ছাড়াও ইপিআই কর্মসূচির সকল কার্যক্রম এসব কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে বাস্তবায়ন করা হয়। বরগুনা সদর উপজেলার হাজারবিঘা কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা নাসিমা আক্তার (২৩) জাগো নিউজকে জানান, তার একমাত্র ছেলে নাঈম গত দু’দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। তাই তিনি তার ছেলের চিকিৎসার জন্য এখানে এসছেন। এর আগে আরো কয়েকবার তার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এ ক্লিনিকে এসেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে কর্তব্যরত স্বাস্থ্য সহকারীর পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধগুলো সেবন করে তিনি ও তার ছেলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়েছেন। হাজারবিঘা গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর মিয়া (৩৫) জাগো নিউজকে জানান, এ ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা অধিকাংশই নারী ও শিশু। এই কমিউনিটি ক্লিনিকের কারণে এলাকার মানুষ বিনা টাকায় চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি ছয় হাজার লোকের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক। এ নীতিমালা অনুসারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের আওতায় বরগুনা জেলার ছয়টি উপজেলায় মোট ১১৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। আর এই ১১৬টি ক্লিনিকের মধ্যে মাত্র ১২টি ক্লিনিকে বিদ্যুৎ সংযোগ এবং নয়টি ক্লিনিকে সৌর বিদ্যুৎ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ল্যাপটপ দিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে রিপোর্ট প্রদানের জন্য প্রতিটি ক্লিনিকে একটি করে ল্যাপটপ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্লিনিকে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় এসব ল্যাপটপ কোনো কাজে আসছেনা। এছাড়াও বরগুনার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত ক্লিনিকগুলোতে ওষুধের সংকট রয়েছে। যার কারণে এসব এলাকার স্বাস্থ্যসেবা ব্যহত হচ্ছে।বরগুনার জেলার আমতলী উপজেলার কলোঙ্কো কমিউনিটি ক্লিনিক এবং বামনা উপজেলার ছোট ভাইজোড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিএইচসিপিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় সবসময়ই এখানে রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। ফলে সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত ওষুধের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি। এছাড়া বিদ্যুৎ না থাকায় সেখানে ইন্টারনেটে মাসিক তথ্য আপলোড করতেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।  বরগুনার জেলা সিভিল সার্জন ডা. রুস্তম আলী জাগো নিউজকে জানান, জেলায় ১১৬টি কমিউনিটি ক্লিনিকের সবগুলো চালু রয়েছে। তিনি আরও বলেন, তৃণমূলের মানুষ এসব ক্লিনিক থেকে সেবা পাচ্ছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্লিনিকগুলোকে আরও সক্ষম করে তুলতে পারলে সারাদেশের গ্রামীন জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় নতুন এক দিগন্তের উম্মোচন করবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, বেশ কিছু ক্লিনিকে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় ওষুধের অতিরিক্ত চাহিদা রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দিয়েছেন তিনি।এমএএস/পিআর

Advertisement