যে স্মৃতি ভুলে যাওয়া উচিত; সেসব স্মৃতিই বারবার আঘাত হানছে মগজে। প্রকৃত অর্থে কিছু স্মৃতি ভুলে যেতে হলেও এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসেবে এন্টিবায়োটিকের মতো কাজ করে। আমার সাংবাদিকতা জীবনে মাকসুদ ভাই সে এন্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করেছেন। প্রায় আট বছর আগে মাকসুদ ভাইয়ের সাথে পরিচয়। ২০১২ সালের আগস্ট কি সেপ্টেম্বরের দিকে সাংবাদিক আলম পলাশ ভাই তাঁর বাসায় নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর বিভিন্ন সময়ে উপদেশ দিয়েছেন। যখনই মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভেঙে পড়তাম; তখনই তাঁর বাসায় গিয়ে বসে থাকতাম। তিনি আমার মাথায় ছায়া দিয়েছেন। আশ্রয় দিয়েছেন। দিয়েছেন কঠিন মুহূর্তে নিজেকে শক্ত রাখার টনিক।
Advertisement
একদিন শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম ভাই আমার উপর খুব রেগেছেন। সে রাগের তেজ আমার অফিস পর্যন্ত পৌঁছায়। অফিসকে আমি বোঝাতে সক্ষম হই। মাকসুদ ভাই আমার পরম শ্রদ্ধেয় মানুষ। একাত্তর টিভিতে কাজ করার শুরুতে তিনি একনিষ্ঠ সহযোগিতা করেছেন। আমি তাঁর কাছে চিরঋণী। পূর্ব থেকে পরিচয় থাকলেও মাকসুদ ভাইয়ের সাথে প্রথম কথা হয় ২০১২ সালে। একদিন দুপুরের পর তালতলার বাসায় গিয়ে কথা বলেছি।
তারপর থেকে আজও নিবিড় সম্পর্ক। কিন্তু সেই সম্পর্কে ছেদ পড়লো সোমবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকালে। এখন তিনি অচীন দেশের অধিবাসী। ভাবতেই বুকের ভেতর হু-হু করে ওঠে। চোখের কোণে জড়ো হয় লোনাপ্লাবন। কিন্তু ঝরে না। কারণ পুরুষের চোখের জল যে কঠিন পাথর। গলে তো গলে না; ফের দলা পাকায়। মৃত্যুর সংবাদ পেয়েই ছুটে যাই তালতলাস্থ তাঁর বাসায়। তখনো মাকসুদ ভাই তার খাটেই প্রাণহীন শুয়ে আছেন। চোখের সামনে গর্জন তোলে অতীত প্রেক্ষাপট। আমার শরীর কাঁপতে থাকে। দুদিন আগেরও ঘরের দরজার চেয়ারে বসে ছিলেন। মোটরসাইকেল থামিয়ে মিনিটখানেক শরীরের অবস্থা জেনে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
মাকসুদ ভাই একটু বেশিই অধিকার খাটিয়ে মাঝেমধ্যে আমার উপর চড়াও হতেন। আমি ভাবি, আমার উপর অধিকার খাটান। তাই সহে যাই, মেনে যাই। ভাইয়ের সাথে আমি কখনো অন্তত বেয়াদবি করিনি। হয়তো তাঁর চাহিদামতো কাজ করতে পারিনি। অবশ্য ইচ্ছে থাকলেও করা হয়ে ওঠেনি। তার জন্য মাফ চাইতে কখনো ইতস্তত বোধ করিনি। ২০১৭ সালের দিকে বেশ কয়েকদিনই বিভিন্ন কারণে আমার উপর খুব বেশি রেগে গিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য ধীরে ধীরে তা প্রশমিত হয়েছিলো। মাকসুদ ভাইয়ের সাথে কখনো মাঠপর্যায়ে কাজ করা হয়নি। তাই ব্যক্তি মাকসুদ ভাই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। যদিও তাঁর নিউজ সেন্স খুব প্রখর। বয়স আর অসুস্থতার কারণে গত বছরখানেক ভালো নিউজ করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু চাঁদপুরের সাংবাদিকতায় তার অবদান অনস্বীকার্য।
Advertisement
চাঁদপুরের অন্যতম প্রধান সাহসী সাংবাদিক ছিলেন তিনি। প্রচুর অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছেন। বছর পাঁচেক আগেও দেখেছি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় তার লেখা নিউজ লিড হয়েছে। একটি স্থানীয় নিউজ কতোটা গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারলে তা জাতীয় দৈনিকে লিড হয়, তা অনুমেয়। অবশ্য সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সন্ত্রাসী হামলারও শিকার হয়েছিলেন মাকসুদ ভাই। সর্বোপরি সাংবাদিকতাকে এমনভাবে উপভোগ করেছেন যে, জীবন নিয়ে ভাবেননি।
মাঝ আর পড়ন্ত বেলায় এসে নিশ্চয়ই এমন আফসোস মনে বাসা বেঁধে ছিলো। তারপরও অসুস্থ সময়েও তিনি সাংবাদিকতা করে গেছেন বর্তমান সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। এজন্য স্যালুট না জানালেই নয়। খারাপ লাগে, যখন দেখি অনেকেই নিজের গায়ে ছাঁতা (ময়লা) লাগিয়ে অন্যের গা পরিষ্কারের কথা বলেন। উপদেশ দেন। বিচার বসান। তাদের প্রতি তীব্র ভর্ৎসনা জানাই। অথচ মাকসুদ ভাই ছিলেন একেবারে ভিন্ন কিসিমের মানুষ।
তিনি আমার শ্রম ও মেধা নিয়ে প্রশংসা করতেন। বলতেন, ‘শরীরের প্রতি যত্ন নিয়েন কাদের, এখন যেভাবে দৌঁড়াচ্ছেন, একসময় পারবেন না’। আমার সম্পদিত পত্রিকা তাঁর বাসায় এক কপি দেওয়ার নির্দেশনা আছে। তিনি পত্রিকাটি পড়ে দু-একটি পরমার্শ দিতেন। আর বলতেন, ‘ভালো হচ্ছে। এবার দৈনিকে রূপান্তর করেন।’ সাপ্তাহিক শপথ একদিন দৈনিক হবে কিন্তু মাকসুদ ভাই দেখে যেতে পারলেন না।
পৃথিবীতে যে ভালো ও ঈর্ষণীয় কাজ করেন, তার সমালোচনা হবেই। মাকসুদ ভাইকে নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। যুগে যুগে এসব হয়ে আসছে। পৃথিবীতে কোনো মানুষ অন্যকে নিয়ে যতই গবেষণা করুক। সে তার নিজেকে যতটুকু জানে তারচেয়ে বেশি অন্য কেউ আবিষ্কার করতে পারে না। মাকসুদ ভাই যে চাঁদপুরের সাংবাদিকতায় একটি বটবৃক্ষ, তা বলতে করোরই দ্বিমত থাকার কথা নয়। সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। তাঁর হাত ধরে অনেকেই সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
Advertisement
শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলমের সাংবাদিকতা শুরু ‘সাপ্তাহিক রূপসী চাঁদপুর’ পত্রিকায়। চাঁদপুর থেকে প্রকাশিত দু’টি দৈনিক পত্রিকার (চাঁদপুর প্রবাহ ও মতলবের আলো) সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ‘দৈনিক আমার চাঁদপুর’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। অন্তত ছয়টি জাতীয় দৈনিকে কাজ করেছেন। চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ২০১৩ সালে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে তিনটি দেশ ভ্রমণ করে তিনটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। আমৃত্যু তিনি ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার চাঁদপুরস্থ স্টাফ রিপোর্টার এবং যমুনা টেলিভিশনের চাঁদপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাংবাদিক মাকসুদ ভাই আজীবন আমার শ্রদ্ধার আসনে থাকবেন। গুণি এ সাংবাদিকের প্রতি অতল শ্রদ্ধা জানাই।
এসইউ/এএ/এমএস