বিশেষ প্রতিবেদন

অন্তর্দ্বন্দ্ব নাকি টার্গেট কিলিং, রক্ত ঝরছে আ.লীগের

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক খুন হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দুর্বৃত্তরা ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে, গুলি করে অথবা পিটিয়ে হত্যা করছে। প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো স্থানে খুনের এমন ঘটনা ঘটছে। কেন এ হত্যাকাণ্ড, তাৎক্ষণিকভাবে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিজেদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল কিংবা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।

Advertisement

এমনও অভিযোগ আছে, দলের হাইব্রিড নেতাদের কমিটিতে প্রবেশ কিংবা দলে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে নানা ধরনের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। পদ-পদবির লোভে নিজ দলের নেতাদের হত্যা করতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করছেন না।

টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল হত্যা

গত ১ আগস্ট টাঙ্গাইলের গোপালপুরে আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল ইসলাম তালুকদার ওরফে নিক্সনকে (৪৮) খুন করে দুর্বৃত্তরা। এদিন রাতে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাড়ি ফেরার পথে তিনি খুন হন।

Advertisement

স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, রাতে মোটরসাইকেলে করে ধনবাড়ী ফিরছিলেন তিনি। এ সময় আজগড়া খালের সেতু থেকে একটু সামনে আগে থেকে ওত পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা তার মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। ধারাল অস্ত্র দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

আমিনুল গোপালপুর উপজেলার হাদিরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তিনি টাঙ্গাইল সদর উপজেলার লায়ন নজরুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন।

হবিগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা কামাল হত্যা

গত ৫ আগস্ট হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বড়ইউড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা কামাল মিয়াকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বড়ইউড়ি ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের নির্দেশে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় বলে অভিযোগ।

Advertisement

২০১৭ সালে নিহত কামাল মিয়ার চাচাত ভাই ইসলাম উদ্দিনকেও খুন করা হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বলা হয়, ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তার অনুসারীরা হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। নিহত কামাল মিয়া ওই মামলায় সাক্ষী ও মামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। মূলত এ বিষয় নিয়ে কামাল মিয়ার সঙ্গে চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের বিরোধ সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি তাদের বিরোধ তীব্র হয়। এরই মধ্যে কামাল মিয়াকে খুনের পরিকল্পনা করেন চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান।

খুলনায় ছাত্রলীগকর্মী নিয়াজকে কুপিয়ে হত্যা

গত ২০ আগস্ট খুলনা মহানগরীর খালিশপুরে ছাত্রলীগকর্মী হাসিবুর রহমান নিয়াজকে (২৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার একটি সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। সেখানে হত্যাকাণ্ডের নির্মম দৃশ্য দেখা যায়। যা দেখে খুনিদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা করছে পুলিশ।

ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলেন- খালিশপুর থানাধীন পৌরসভার মোড় এলাকার মৃত আ. কাদেরের ছেলে ইথুম, পিপলস পাঁচতলা নতুন কলোনির গোলাম মোস্তফার ছেলে তুষার (২৩), মো. নাজমুলের ছেলে সাকিব (২১) এবং আব্দুর রহমানের ছেলে নাঈমুর রহমান ফাহিম (১৮)।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, খালিশপুর লাল হাসপাতালের সামনে এসআর ক্রিয়েটিভ কাটস অ্যান্ড কফি সেলুনের ওয়েটিং রুমে ঢুকে ১০/১৫ জন সন্ত্রাসী ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হাসিবুর রহমান নিয়াজসহ তিনজনকে গুরুতর জখম করে। ঘটনাস্থলেই নিহত হন হাসিবুর রহমান।

কুষ্টিয়ায় এমপির ফুফাত ভাই হাসিনুরকে কুপিয়ে হত্যা

গত ৩০ আগস্ট কুষ্টিয়া-১ আসনের এমপি আ ক ম সারওয়ার জাহান বাদশার ফুফাত ভাই হাসিনুর রহমানকে (৫২) প্রকাশ্যে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় মামলা দায়ের হয়। মামলায় একই এলাকার বাসিন্দা মজিবর রহমান বয়াতি ও তার ছেলে জাহাঙ্গীরের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়।

ঘটনার পরপরই মজিবর বয়াতিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে মজিবর বয়াতির ছেলে জাহাঙ্গীর পলাতক রয়েছেন। নিহত হাসিনুর রহমান উপজেলার ফিলিপনগর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।

নাটোরে নিজ মেয়ের হাতে খুন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা

গত ৩১ আগস্ট নাটোরের সিংড়ায় নিজ মেয়ে মিরার (৩০) লাঠির আঘাতে খুন হন আব্দুস সাত্তার (৮০) নামে এক ব্যক্তি। তিনি হাতিয়ান্দহ ইউনিয়ন ৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। নাটোরের সিংড়া উপজেলার হাতিয়ান্দহ ইউনিয়নের আচলকোট গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ নিহতের কন্যাকে আটক করে।

নাটোরে আওয়ামী লীগ নেতার ছুরিকাঘাতে কর্মী খুন

গত ৬ সেপ্টেম্বর পারিবারিক বিরোধকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল ইসলামের ছুরিকাঘাতে খুন হন একই দলের নারীকর্মী শিল্পী বেগম (৪০)। এ সময় আহত হন একজন। নাটোরের সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নের বড় চৌগ্রাম গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

নিহত শিল্পী বেগম চৌগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মৃত ইদ্রীস আলী মণ্ডলের সহধর্মিণী এবং আহত লাভলী পারভীন নিহতের ছোট বোন বলে জানা গেছে।

ওই ঘটনায় মূলহোতা চৌগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলামের বড় ভাই সাইফুল ইসলাম ও ভাতিজা সাদ্দাম মণ্ডলকে আটক করে সিংড়া থানা পুলিশ।

খুলনায় ছাত্রলীগকর্মী নিয়াজ হত্যার ভিডিও

বান্দরবানে আওয়ামী লীগ নেতা চাইন ছাহ্লা খুন

গত ১৬ জুন সন্ত্রাসীদের গুলিতে বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নিহত হন। ওইদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে ইউনিয়নের বাকিছড়া এলাকার মাঝের পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। নিহতের নাম চাইন ছাহ্লা (৩৮)। তিনি বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউপির ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য ছিলেন। ঘটনার পরপর স্থানীয়রা গুরুতর অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বান্দরবান সদর হাসপাতালে, পরে অবস্থার অবনতি হলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১২টার দিকে তিনি মারা যান।

সিরাজগঞ্জে সন্ত্রাসী হামলায় ছাত্রলীগের নেতা খুন

গত ৫ জুলাই সিরাজগঞ্জ শহরের বাজার স্টেশন এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন জেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক এনামুল হক বিজয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে মারা যান তিনি। জামতৈল সরকারি হাজি কোরপ আলী ডিগ্রি কলেজ শাখার সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন বিজয়।

নড়াইলে আওয়ামী লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা

গত ২৭ মে রাতে নড়াইলের কালিয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতা কাইয়ুম সিকদারকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় আহত হন তিনজন। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এ ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয়দের ধারণা। আবদুল কাইয়ুম সিকদার উপজেলার নড়াগাতি থানার কলাবাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কলাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের তিন নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ছিলেন।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দুই মোটরসাইকেলে করে আবদুল কাইয়ুমসহ চারজন উপজেলা শহর থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। কালিনগর গ্রামে পৌঁছলে তাদের থামিয়ে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে সন্ত্রাসীরা চলে যায়। ঘটনাস্থলে আবদুল কাইয়ুম নিহত হন। আহত হন তার সঙ্গী আবুল হাসনাত মোল্লা, মতিয়ার মল্লিক ও সজিব মল্লিক। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনজনকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

হবিগঞ্জে কামাল মিয়াকে কুপিয়ে হত্যা

গত ২২ জুলাই হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে কামাল মিয়া (৪০) নামের এক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওইদিন সন্ধ্যায় তাকে উপজেলার শিবগঞ্জ বাজারে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাত ১১টার দিকে তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনার পর তিনি মারা যান।

নিহত কামাল মিয়া হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বরইউরি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

ফরিদপুরে অন্তর্দ্বন্দ্বে হায়াত আলী নিহত

গত ৮ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে আহত হন বানা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা হায়াত আলী। ওইদিন রাতে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে তিনি মারা যান।

ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বোয়ালমারী আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও উথলী গ্রামের বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীর হোসেনকে আসামি করা হয়।

চট্টগ্রামে বখতিয়ার নিহত

গত ৭ মে কথা কাটাকাটির জেরে প্রতিপক্ষ যুবকদের মারধরে বখতিয়ার সিকদার (৪৯) নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা নিহত হন। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। বখতিয়ার সিকদার গড়দুয়ারা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

চাঁদপুরে আজিজুর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা

গত ১৯ মে চাঁদপুর সদর উপজেলার কুমারডুগী এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা আজিজুর রহমান ভুট্টোকে (৩৬) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ভুট্টো সদর উপজেলার ৪নং শাহমাহমুদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও সার ব্যবসায়ী ছিলেন।

দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খুন হচ্ছেন— এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খুন হচ্ছেন, এমন অবজারভেশনের (পর্যবেক্ষণ) সঙ্গে আমি একমত নই। কেউ কারও সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে, ফলে খুনের ঘটনা ঘটছে। কেউ কারও বিরুদ্ধে মামলা বা কেস দিচ্ছে, এ নিয়ে খুনের ঘটনা ঘটেছে। তবে এ কথা ঠিক যে, বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে খুন হচ্ছেন। এমন ঘটনা ঘটলে আওয়ামী লীগ সেগুলো দেখছে।’

আওয়ামী লীগের অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন অপশক্তি এসব খুনের সঙ্গে জড়িত। দেশ পরিচালনায় আওয়ামী লীগ যে উন্নয়ন করেছে, তা অনেকের সহ্য হচ্ছে না। বিভিন্ন স্থানে এই অপশক্তি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের টার্গেট করে হত্যা করছে। আমরা এগুলো তদন্ত করছি। খুনিদের অবশ্যই খুঁজে বের করে শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করাব।’

এফএইচএস/এমএআর/জেআইএম