চরের মধ্যে মানুষের ছোটখাট অসুখ-বিসুখ হইলেও আগে অনেক সমস্যায় পড়তে হইতো। নদী পাড় দিয়া শহরে যাইয়্যা ডাক্তার দ্যাহায়া ওষুধ আনোন লাগতো। এহন আর সেই সমস্যা নাই, সরকার চরের মধ্যে ক্লিনিক খুইল্যা দিছে। সেই ক্লিনিকের আপাই এখন রোগী দেইখ্যা ওষুধ দেয়, ট্যাহাও লাগে না। কথাগুলো বলছিলেন গোদাশিলা কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা শরিফপুর ইউনিয়নের গোগাশিমলা গ্রামের কাঠমিস্ত্রি আব্দুর রশিদের প্রসূতি স্ত্রী লাইলী বেগম। শুধু লাইলী বেগমই না একই গ্রামের হালিমা, জয়বানু, ইয়ার আলীর মতো অনেকেই এসেছেন চিকিৎসা নিতে। গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা কমিউনিটি ক্লিনিকের সুফল ভোগ করেছে জামালপুরের হতদরিদ্র মানুষেরা। নদী ভাঙন কবলিত জামালপুরের বিভিন্ন দুর্গম চর আর গ্রামাঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষে স্বাস্থ্যসেবার অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে আশার আলো হয়ে কাজ করছে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যানুসারে, গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আ. লীগ সরকার সারাদেশে ১০ হাজার ৬শ’টি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপির সরকার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দিলে প্রায় ৮ বছর এর কার্যক্রম বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আবারো কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম শুরু করা হয় এবং ২০১৪ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ১২ হাজার ৮১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ও এর কার্যক্রম চালু রয়েছে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ৩০ প্রকার ওষুধ বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে এবং ৯শ’টি ক্লিনিকে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ঠান্ডা-জ্বর নিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে আসা জয়বানু জানায়, আমাদের গ্যারামে কোনো ওধুষের দোকান নাই। ট্যাহা দিয়াও এডা ওষুধ-পত্রর পাওয়া যাইতো না। আগে জ্বর-টর হইলে বড়ির অভাবে কষ্ট কইর্যাই দিন পার করতাম। আর এহন বাড়ির বুলগই ডাক্তারের ঘর। কিছু হইলেই এহানে আসি, ট্যাহা ছাড়াই ওষুধ নিয়া যাই।আর চর্ম রোগের চিকিৎসা সেবা নিতে আসা আহেদ আলী মন্ডল বলেন, সারা শইল যুইর্যাই খালি চুলকায়। তাই এহেনে মলম নিবার আইছি, মলমডা খুব ভালা। এর আগেও নিয়া গেছিলাম, খুব ভালো কামে দিছে। ক্লিনিকটা যদি বাড়ির কাছে না হইতো, তাইলে এই চর ডেইঙ্গা যাইয়া শহরতনে মলম আনোন লাগতো। জামালপুর সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, জামালপুরের ৭ উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়নে বর্তমানে ২৭৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। এছাড়াও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। ৯টি ক্লিনিকের প্রস্তাবনা রয়েছে, জমি সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে সেগুলো চালু করা হবে। বর্তমানে জামালপুর জেলায় ২৯০ জন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার কাজ করছে। এরা শুক্রবার এবং সরকারি বিভিন্ন ছুটিরদিন ছাড়া সপ্তাহে ৬ দিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রতি সপ্তাহে ৩ দিন ২ জন পরিবার কল্যাণ সহকারী কাজ করে। এদের মধ্যে একজন কমিউনিটি ক্লিনিকে এবং অন্যজন মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ দিয়ে থাকে। জামালপুর স্বাস্থ্য বিভাগের সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার বদরুর আলম জাগো নিউজকে জানান, ২০১৪ সালে জামালপুরের ২৭৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে ৮ লাখ ১৪ হাজার ১১১ জন পুরুষ এবং ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২৯৮ জন নারী স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে শিশু স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা গ্রহণকারী ৫ বছরের কম বয়সী ছেলে শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ২৭ হাজার ৫২২ জন এবং মেয়ে শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ৪৪ হাজার ৮২৯ জন। কমিউনিটি ক্লিনিকের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী পুরুষের সংখ্যা ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৮৫৭ জন এবং ১৩ লাখ ৪৫ হাজার ৮৬ জন নারী রয়েছে। এছাড়াও গর্ভকালীন সেবা গ্রহণকারী ৬৫ হাজার ১৮৫ জন এবং স্বাভাবিক সন্তান প্রসব সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা ১ হাজার ২৬২ জন। গোদাশিমলা কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার রূপালী খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, আমার এখানে প্রতিদিন প্রায় ৪০/৫০ জন রোগী সেবা নিতে আসে। রোগীদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। গ্রামের মানুষদের অল্পপরিসরে হলেও স্বাস্থ্যসেবা দিতে পেরে আমি নিজেও অনেক আনন্দিত।এ ব্যাপারে জামালপুরের সিভিল সার্জন ডা. মোশায়ের উল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে পারায় জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর উপর কিছুটা চাপ করেছে। এতে করে গ্রামের মানুষদের কষ্টটাও অনেকাংশেই কমে এসেছে। গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা বাড়ানোর লক্ষ্যে জামালপুরে আরো নতুন কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।এসএস/আরআইপি
Advertisement