আন্তর্জাতিক

নারী হয়েও পুরুষ অধিকারের পক্ষে লড়ছেন যিনি

নারী হয়েও পুরুষের মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করে ব্যাপক পরিচিত পাওয়া পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার কর্মী নন্দিনী ভট্টাচার্য বলছেন, ভারতে প্রায় ১৮ শতাংশ পুরুষ যৌন নিপীড়নের শিকার হন। কিন্তু পুরুষরা সেকথা বাইরে বলতে পারেন না। শুধু তাই নয়, তিনি বলছেন, ভারতের আইন প্রায় পুরোটাই নারীদের পক্ষে। সেজন্য আইনে প্রকৃত সমতা আনতে চান তিনি। পুরুষ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজে গড়ে তুলতে চান গণ-আন্দোলন।

Advertisement

কেন নারী হয়ে পুরুষের অধিকারের পক্ষে লড়াই জারি রেখেছেন নন্দিনী, সেই লড়াই-সংগ্রামের কথা নিয়ে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মুখোমুখি হয়েছিলেন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস : পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে হঠাৎ পুরুষদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার কি দরকার পড়ল?

নন্দিনী ভট্টাচার্য : পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একটা মিথ। আমাদের ভুল ধারণা যে আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করি। এক সময় এটা ছিল, খুব বেশিভাবেই ছিল। মেয়েরা তখন অত্যন্ত নির্যাতিত হতেন, এখনও হন না, একথা আমি বলছি না। তবে এখন আর খুব বেশি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নেই। এই ধারণা বহু দিন ধরে চলে আসছে। আমাদের বোধ হয় এবার এটা বদলানোর সময় এসেছে। দেখবেন অনেক বাড়িতে ঠাকুর মা অথবা মা কিংবা স্ত্রীর বাড়ির নানা নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি ঢুকে পড়েছে। আমি কিন্তু, অর্থনৈতিক জায়গা থেকে বলছি না। বরং বলছি, সামাজিক অবস্থানগত দিক থেকে।

Advertisement

লক্ষ্য করবেন, ছেলে মেয়ে কোন স্কুলে বা টিউশনে পড়বে, মা না শাশুড়ি কাকে বেশি দামি শাড়ি দেয়া হবে- এসব সিদ্ধান্ত মোটামুটি এখন পরিবারের নারীরাই নিয়ে থাকেন। আর, পুরুষরা ঠিক করেন ফারাক্কাকে কত কিউসেক পানি দেয়া হবে বা আনবিক বোমা ফাটানোর রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল, এগুলো। এর থেকেই বোঝা যায়, পরিবার এবং বৃহত্তর পরিবার অর্থাৎ সমাজের দরকারি সিদ্ধান্তগুলো নারীরাই নিয়ে থাকেন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস : কেন একথা বলছেন? এটাও তো বলা যায় যে কে কোন সিদ্ধান্ত নেবে সেই সিদ্ধান্তই পুরুষতান্ত্রিকতা ঠিক করে দিয়েছে।

নন্দিনী ভট্টাচার্য : দেখুন, দেশ-রাষ্ট্র-দুনিয়া এসব বড় বড় ব্যাপার। আপনার দৈনন্দিন বেঁচে থাকার জীবনে ছেলে-মেয়ে কোন স্কুল-কলেজে পড়বে বা কোন পেশা বেছে নেবে অথবা বাড়ির জন্য কোন গাড়িটি কেনা হবে, এগুলোই মূলত গুরুত্বপূর্ণ। আর সেসব মূলত পরিবারের নারী সদস্যরাই আজকাল ঠিক করে থাকেন। অর্থাৎ পুরুষরা বহু ক্ষেত্রেই আর সংসারের ‘ডিসিশন মেকার’ নয়। মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও কিন্তু অনেকটা বেড়েছে, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস : অবশ্যই। এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তো নারী ক্ষমতায়নের দীর্ঘ প্রতিক্ষিত সুফল। এতে সমস্যাটা কোথায়?

Advertisement

নন্দিনী ভট্টাচার্য : ঠিক সে অর্থে সমস্যা নয়। বলতে চাইছি, এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আজ আর সেভাবে নেই, অনেকটা ফিকে হয়েছে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস : কিন্তু, আপনি যে ছবিটা দিতে চাইছেন তা তো শহর-মফঃস্বলের। মূল যে গ্রামীণ ভারত সেখানকার ছবিটা তো ভিন্ন।

নন্দিনী ভট্টাচার্য : আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। আমার বাড়িতে যে মেয়েটি কাজ করেন তাঁর মাস গেলে ৮-১০ হাজার টাকা রোজগার। ওঁর স্বামী রঙের মিস্ত্রি, কিন্তু এখন কোনো কাজ নেই সেই ভদ্রলোকের। আমার বাড়িতে কাজ করাকালীন মেয়েটি যে ভঙ্গিতে স্বামীকে বাড়ির রান্না-বান্না করতে বা অন্যান্য বিষয়ে নির্দেশ দেয়, তাতে আমার মনে হয় না যে তিনি আর পুরুষতান্ত্রিকতার মধ্যে রয়েছেন। দেশে দেশে কালে কালে যখন যার হাতে ক্ষমতা থাকে তারাই মাথায় বসে। মেয়েদের হাতে অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতা যাচ্ছে। মনে রাখবেন, পাওয়ার কোরাপ্টস।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস : আংশিকভাবে কিছু ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিকতা ফিকে হচ্ছে বলে মনে করছেন বলেই কি আপনাদের মনে হয় পুরুষাধিকার রক্ষা জরুরি?

নন্দিনী ভট্টাচার্য : না, না, একেবারেই তা নয়। ভারত একটি প্রো-ফেমিনিস্ট কান্ট্রি। আমাদের দেশে মেয়েদের জন্য ৪৯টি আইন আছে। অথচ পুরুষ মানুষের জন্য কোনো আইন নেই। তবে কয়েকটা প্রিকশন আছে। কিন্তু, পুরুষরা তা জানেনই না। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলে পুরুষরা ভয়ে কাঁটা হয়ে যান। আমাদের কাজ দেশের আইনে প্রকৃত লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই। নিরাপরাধ পুরুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাহায্য করা।

কিছুদিন আগে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। এতে দেখা যায়, স্ত্রীর তার স্বামীকে বেধড়ক মারপিট করছেন। সেই পুরুষটি যদি থানায় যেতেন, তবুও তিনি অভিযোগ জানাতে পারতেন না। কারণ, আমাদের দেশের আইন হল- ‘প্রোটেকশন অব উইমেন ফ্রম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স।’ আমরা চাই, গার্হস্থ্য হিংসার এই আইন, লিঙ্গ নিরপেক্ষ হোক।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস : যে দেশে ঘণ্টার হিসাবে পুরুষের হাতে ধর্ষণ-শ্লীলতাহানি-যৌন হেনস্থা ঘটে সেখানে দাঁড়িয়ে পুরুষাধিকার নিয়ে কথা বলাটা কি ন্যায্য?

নন্দিনী ভট্টাচার্য : কী বলতে চান, পুরুষই শুধু ধর্ষণ-যৌন হেনস্থা করে? এ দেশে ১৮ শতাংশ পুরুষও নারীদের হাতে যৌন হেনস্থা-ধর্ষণের শিকার। কিছুদিন আগে পার্লামেন্টকে অনুরোধ করা হয়েছিল যাতে ধর্ষণের আইনটাকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ করা হয়। কিন্তু আমাদের মহান সংসদ তা অস্বীকার করেছে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস : ধর্ষিত বা যৌন নিপীড়নের শিকার পুরুষ আপনাদের কাছে আসে? এ ক্ষেত্রে ব্যাপারগুলো কেমন হয়?

নন্দিনী ভট্টাচার্য : আমাদের কাছে এমন পুরুষরা আসেন। বহু ক্ষেত্রেই সেগুলো পুরুষদের বিরুদ্ধে ভুয়া ধর্ষণ মামলা। আসলে ঘটনা অন্য রকম হয়।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস : মানে? এসব পুরুষদের সাধারণত কে ধর্ষণ করে থাকে?

নন্দিনী ভট্টাচার্য : পরিবারের মধ্যেই কখনো হয়। তাছাড়া পাড়ার কাকিমা, পিসি, দিদিরা করে থাকেন। এ ধরনের ঘটনার একটা বড় অংশের শিকার হয় বয়ঃসন্ধির ছেলেরা। তারা যখন বাড়িতে এসে মা-বাবাকে বলে, তারা বলেন, এসব বলতে নেই। তিনি তোমাকে ভালবাসেন। মেয়েরা এমন অভিযোগ করলে এখন তাও বাবা-মায়েরা গুরুত্ব দিয়ে সে কথা শুনে ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু আজও ছেলেরা এসব বললে কেউ গুরুত্ব দেয় না লোকলজ্জার ভয়ে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস : সেই সব পুরুষরা কেন সরব হন না? এ ক্ষেত্রে আপনাদের কেস স্টাডি কী বলছে?

নন্দিনী ভট্টাচার্য : কৈশোরে ভয় পায়। আর বড় হয়েও ভয়-লজ্জা পায়। কারণ, বড় হয়ে যাওয়ার পর সে যে পুরুষ, তাঁর মুখে এসব কথা মানায় না- এ বোধটা জন্মে যায়।

এসআইএস/পিআর