শুটকি মৌসুম শুরু হলেও মৎস্যজীবী জেলেরা এখনো যেতে পারছেন না বঙ্গোপসাগরের দুবলার চরে। সুন্দরবনের নৌপথ ব্যবহারে বনবিভাগ নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও পাস-পারমিট বন্ধ করায় এ বছর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ ও শুটকি প্রক্রিয়াকরণ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় উপকূলের হাজার হাজার জেলে সমুদ্রগামী ট্রলার জাল-নৌকা ও শুটকি তৈরির সরঞ্জামাদি নিয়ে ভাসছে সমুদ্রের দীপাঞ্চল ও বন সংলগ্ন নদীতে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সমুদ্রে গিয়েও বনরক্ষীদের তোড়ের মুখে বনসংলগ্ন সমুদ্র চরে ভিড়তে পারছে না, আবার কেউ যাত্রাপথে আটকা পড়েছেন মংলাসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন পয়েন্টে।এতে বেকারত্বের পাশাপাশি এ অঞ্চলের প্রায় দু’লাখ মৎস্য জীবী-ব্যবসায়ী ও শ্রমিক পরিবার তাদের শত বছরের পুরানো পেশা নিয়ে অজানা শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। অপর দিকে এ খাতে অন্তত দুই কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হতে যাচ্ছে বনবিভাগ। কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বনবিভাগ আকস্মিক এমন সিদ্ধান্ত নেয়ায় ক্ষুব্ধ জেলেরা। তাদের পেশাগত ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বনবিভাগ বিলম্ব করলে কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি স্বোচ্ছায় আত্মহুতির হুমকি দিয়েছেন জেলেরা।শুটকি ব্যবসায়ী ও জেলে সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে মৎস্য আহরণকে ঘিরে সুন্দরবন সাগর পাড়ের চর ও দ্বীপাঞ্চলে শুরু শুটকি প্রক্রিয়াকরণ মৌসুম। প্রতি বছর অক্টোবর ও শীতের শুরুতেই এ মৌসুমকে সামনে রেখে সমুদ্র যাত্রায় নেমে পড়ে উপকুলের হাজার হাজার জেলে। সমুদ্রে মৎস্য আহরণ ও শুটকি তৈরির কাজে জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ী জড়ো হয় সুন্দরবনের দুবলার চর, মেহের আলীর চর, আলোরকোল, অফিসকিল্লা, মাঝেরকিল্লা, শেলার চর, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, বড় আমবাড়িয়া, মানিকখালী, কবরখালী, চাপড়াখালীর চর, কোকিলমনি ও হলদাখালীসহ আশপাশের চরে।সুন্দরবন অভ্যন্তরে কমপক্ষে ১৫টি মৎস্য আহরণ, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণ কেন্দ্র নিয়ে এ দুবলা জেলে পল্লী। জেলেরা নিজেদের থাকা, মাছ ধরার সরঞ্জাম রাখা ও শুটকি তৈরির জন্য প্রতি মৌসুমে অস্থায়ী ঘর ও মাচা তৈরি করে থাকে চরাঞ্চলে। সমুদ্র মোহনায় বেহুন্দীসহ বিভিন্ন প্রকার জাল দিয়ে মাছ শিকার করে তা বাছাই করে জাতওয়ারী মাছগুলো শুটকি করে থাকেন জেলেরা।কিন্তু এ বছর শুটকি মৌসুম শুরু হলেও জেলেরা সমুদ্র ও চরাঞ্চলে যেতে পারছেন না। আকস্মিকভাবে পশুর নদী হয়ে দুবলা রুটে ফিসিং ট্রলার যাতায়াতে বনবিভাগের নিষেধাজ্ঞায় বিপাকে পড়েছে সমুদ্র নির্ভর মৎস্যজীবীরা। মৎস্য আহরণকারীদের সমুদ্রে (দুবলার চর-আলোরকোল) যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সুন্দরবনে নৌপথ ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা। পুর্ব ঘোষণা ছাড়াই এমন সিদ্ধান্তের যাতাকলে আটকা পড়েছেন উপকূলের সমুদ্রগামী হাজার হাজার জেলে। ইতিমধ্যে বরিশাল ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের জেলেদের একটি অংশ সমুদ্রে পৌঁছালেও দুবলার চরাঞ্চলে তাদের ভিড়তে দিচ্ছে না বনরক্ষীরা।অপর দিকে বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের জেলে বহরের বড় একটি অংশ মংলাসহ সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন পয়েন্টে আটকে আছেন। প্রায় একমাস যাবৎ তারা জাল-নৌকাসহ শুটকি তৈরির সরঞ্জামাদি নিয়ে সমুদ্রের চরাঞ্চল ও সুন্দরবন সংলগ্ন নদীতে। এ অবস্থায় অন্তত দু’লাখ মৎস্যজীবী পরিবার অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। অপর দিকে বিদেশি জেলেদের অনুপ্রবেশে সুন্দরবন উপকূল অনিরাপদ হওয়াসহ সরকার মোটা অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে।এ বিষয়ে বনবিভাগ দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সমুদ্রগামী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নেতারা। সংগঠনটির সভাপতি মো. সহিদ মল্লিক আক্ষেপ করে বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বনদস্যুদের উৎপাত আশঙ্কার মধ্যেও জীবন জীবিকার তাগিদে সাগর পাড়ের চরাঞ্চলে রুজি-রুটির জন্য ছুটে থাকে দরিদ্র জেলেরা। আর এ জেলে পল্লীতে জেলেদের ঘর তৈরি ও শুটকি প্রক্রিয়াকরণের এ খাতে নির্ধারিত রাজস্ব আদায়ও করে থাকে সুন্দরবন বন বিভাগের দুবলা টহল ফাঁড়ি।এ বছর বনবিভাগ হঠাৎ বনের নৌপথ ব্যবহারসহ শুটকি প্রক্রিয়াকরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মো. শুকুর আলী মীর জানান, সমুদ্রে যাত্রার অপেক্ষায় আটকে রয়েছেন অন্তত ৩৫ হাজার জেলে। সমুদ্রে ভাসমান ও বিভিন্ন পয়েন্টে আটকে থাকা প্রতিটি নৌকার ফুয়েল খাবার ও শ্রমিক মজুরিতে ব্যয় হচ্ছে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা।তিনি জানান, অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাস শুটকি আহরণের মৌসুম। এর মধ্যে একমাস অতিবাহিত করছেন বনবিভাগের পাসপারমিট ও অনুমতির অপেক্ষায়। সমুদ্রগামী বেশির ভাগ জেলেই ব্যাংকলোনসহ বিভিন্ন এনজিও এবং আড়ৎদারদের কাছ থেকে সুদের কিস্তিতে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। এ অবস্থায় জেলে পরিবারগুলোতে চরম হা-হাকার অবস্থা বিরাজ করছে। তাই এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেছেন, অর্থলগ্নির বোঝা মাথায় নিয়ে জেলেদের বাড়ি ফেরার অবস্থা নেই। তাই তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি স্বেচ্ছায় আত্মহতির জন্যও প্রস্তুত তারা।দুবলার মৎস্য ব্যবসায়ী আ. হালিম গাজী ও গোলাম রসুল জানান, বনবিভাগের অনুমতি না পেয়ে বাধ্য হয়ে মৎস্যজীবীরা কেউ কেউ বলেশ্বর-বগী-চর দুয়ানী-কচিখালি-দুবলা বিকল্প রুট ব্যবহার করছেন। এতে পূর্বের ১২০-১৫০ কিলোমিটারের স্থলে বর্তমানে দূরত্ব দাঁড়িয়েছে ৬-৭শ’ কিলোমিটার। এ পথে সময়ের ব্যবধান চারগুণ বেড়েছে। অর্থাৎ ৮ ঘণ্টার স্থলে বর্তমানে এ পথ অতিক্রম করতে ৩২ ঘণ্টা সময় ব্যয় হচ্ছে। যে সব জেলেরা দুবলার চরাঞ্চালে পৌঁছেছেন তারা একদিকে সমুদ্র জলোচ্ছ্বাস থেকে জীবন বাঁচাতে জরিমানার ভয়ে জেলেরা চরাঞ্চালে ভিড়তে পারছেন না বলে জানিয়েছেন জেলেরা। এতে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে নিরুপায় অনেক জেলেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছেন।এ প্রসঙ্গে দুবলা শুটকি পরিবহন ব্যবসায়ী জালাল আহম্মেদ বুলবুল জানান, বনবিভাগের হঠকারি সিদ্ধান্তে একদিকে যেমন এখাতে দুই কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব হারাবে সরকার। অপর দিকে শুটকি মৌসুমনির্ভর দেশীয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার জেলেসহ সংশ্লিস্ট প্রায় দুই লাখ পরিবার চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, সমুদ্রে দেশীয় জলসীমায় এ দেশীয় জেলেদের অনুপস্থিতিতে ভারত, মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশের জেলেরা কোটি কোটি টাকা সমমূল্যের মৎস্য সম্পদ অবাধে লুটে নেয়ার সুযোগ পাবে।এ বিষয়ে দুবলা ফিসারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান (অব.) মেজর জিয়া উদ্দিন জানান, মৎস্যজীবীরা কখনো বণ্যপ্রাণি শিকার করে না। কারণ বন ও সমুদ্র সম্পদের ওপর তাদের জীবিকা নির্ভর। জেলেদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করে হঠাৎ চলাচলের এ পথ বন্ধ করে দেয়া আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত।তিনি আরো বলেন, সমুদ্রগামী জেলেরা বনের অভ্যন্তরে মাছ শিকার করে না। জেলেরা সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ শুটকি প্রক্রিয়া করার জন্য সাগরপাড়ের বালুচরে অস্থায়ী বসতি গড়ে তোলে, বনের ভেতর নয়। এ ক্ষেত্রে বন সুরক্ষা করেই সমুদ্রগামী জেলেদের পশুর নদী দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।তবে খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক ড. সুনীল কুমার কুন্ডু জানান, সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে জেলেদের বাঁধা নেই। তবে দুবলার চর সংরক্ষিত বন এলাকা হওয়ায় সেখানে মাছ ধরা ও বসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আর সুন্দরবনের পশুর নৌ রুট দিয়ে জেলেদের যাতায়াতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পেলে এ রুটের অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়।বিএ
Advertisement