বিনোদন

যৌথ প্রযোজনার ব্ল্যাক নিয়ে ব্ল্যাক আউট!

যখন ঢাকার ছবির জোয়ার ছিলো তখন যৌথ প্রযোজনার ছবি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিলো ইন্ডাস্ট্রিতে। দেশি তারকাদের পাশাপাশি সেসব ছবিতে দর্শকরা পেতেন পাকিস্তান-ভারত-শ্রীলংকাসহ অন্যান্য দেশের বিখ্যাত তারকাদের অভিনয় দেখার সুযোগ। সময়ের পরিক্রমায় আমাদের চলচ্চিত্রের সেই দিন আর নেই। বন্ধ হচ্ছে সিনেমা হল। নেই সেই হৃদয় ছোঁয়া গল্প, সেই নির্মাণ। সেই মানের নির্মাতা-শিল্পী ও কলাকুশলীও। কিন্তু রয়ে গেছে যৌথ প্রযোজনার প্রাচীন ব্যবস্থাটি।পরিতাপের বিষয় হলো বিগত কয়েক বছর ধরেই চরম অনিয়মের মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে দুই দেশের প্রযোজনার ছবিগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে বিষয়টি দারুণভাবে আলোচনায় এসেছে। অভিযোগ উঠেছে, যৌথ প্রযোজনার নামে যারাই ছবি নির্মাণ করেছেন তারা প্রতারণা করছেন দর্শকদের সাথে। এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন কলকাতার রাজা চন্দ ও ঢাকার কিবরিয়া লিপুর যৌথ পরিচালনায় ছবি ‘ব্ল্যাক’। ছবিটিতে প্রথমবারের মতো জুটি হয়েছেন দুই বাংলার জনপ্রিয় দুই তারকা কলকাতার সোহম এবং বাংলাদেশের মিম। ঢাকার প্রেক্ষাপটে অভিযোগের শেষ নেই ব্ল্যাক ছবির বিরুদ্ধে। কলকাতার এক বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, এরইমধ্যে ব্ল্যাক ছবির পোস্টারে ছেয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গ। পোস্টারে বলা হচ্ছে এটি আগামী ১০ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব কালী পূজার ছবি। তার মানে ছবিটি সেখানে সেন্সর পেয়ে গেছে। কারণ, সেন্সর ছাড়পত্র না পেলে ছবির পোস্টার ছাপানো যায় না। মুক্তির তারিখও ঠিক করা যায় না। এই আইন যেমন ঢাকাতে, খোঁজ নিয়ে জানা গেল কলকাতাতেও তাই। অথচ ঢাকায় সেন্সর বোর্ডে খোঁজ নিতে গেলে এই ছবির ব্যাপারে কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি! তবে মাত্র ৭দিনের মধ্যে কেমন করে ঢাকায় মুক্তি দেয়া হবে এই ছবিটি- এর কোনো উত্তর মিলেনি! সেইসাথে আরো জানা গেছে, গেল ২৭ ও ২৮ অক্টোবর ছবিটির দুটি গানের শুটিং করতে ব্ল্যাক ছবির টিম হাজির হয়েছিলো কক্সবাজারে। টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসেছিলো এই টিমের কলকাতার সদস্যরা! প্রশ্ন উঠেছে এই শুটিং নিয়ে। যে ছবিটি ২৭ তারিখের আগেই সেন্সর পেয়ে গেছে সে ছবির টিম কেন গানের শুটিং করতে কক্সবাজার আসে? ২৭ তারিখের আগেই তো কলকাতায় ছবির পোস্টার প্রকাশ ও প্রচারণা শুরু হয়েছে। তবে কী ছবি না দেখেই সেখানে সেন্সর দেয়া হয়? নাকি এই শুটিং বাংলাদেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ ব্যবস্থাকে ‘আইওয়াশ’ করার চেষ্টা?এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ছবিটির ঢাকার পরিচালক কিবরিয়া লিপুর মোবাইলে বারবার কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ম্যানেজার রুহুলও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। পাশাপাশি, যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা থেকে জানা গেছে, যখন দুটি দেশ এক হয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চায়, তখন সেই ছবিটির সবকিছুতেই দুই দেশের সমান অংশগ্রহণ থাকে। কিন্তু বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে এই ছবির প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী ও কলাকুশলী- সবকিছুতেই কলকাতার ৯০ ভাগ মালিকানা। কলকাতায় প্রকাশ হওয়া পোস্টারে উপেক্ষিত বাংলাদেশ। সেখানে বলা হয়েছে ছবির পরিচালক রাজা চন্দ, প্রযোজক রানা সরকার। এর কাহিনী, চিত্রগ্রহণ, গানের কথা-সুর সবই কলকাতার। ছবিতে বাংলাদেশের বলতে কেবল মিমকেই খুঁজে পাওয়া গেছে।এমনকী কলকাতায় মুক্তি পেতে যাওয়া ‘ব্ল্যাক’ ছবিতে বাংলাদেশের কোনো দৃশ্যও থাকছে না। গেল ২৪ অক্টোবর ব্ল্যাক ছবিটির দৃশ্যধারণ নিয়ে বেশ কিছু গণমাধ্যমে সমালোচনা হওয়ার পর পরিচালক লিপু কক্সবাজারে কিছু দৃশ্যধারণ করেছেন। যাতে দায় সারানোর জন্য ছবিটি ঢাকায় মুক্তির দেয়ার সময় বাংলাদেশের কিছু লোকেশন তিনি যোগ করতে পারেন। এদিকে যৌথ প্রযোজনায় অভিজ্ঞ বেশ কয়েকজন প্রবীন প্রযোজকদের  সাথে কথা বলে জানা গেছে, যৌথ প্রযোজনার ছবিগুলো একই সময়ে নিজ নিজ দেশে মুক্তি দিতে হয়। কিন্তু ব্ল্যাক ছবিটি এই নিয়মও মানছে না। এটি ঢাকায় মুক্তি পাবে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে। অথচ টালিগঞ্জে আসছে কালীপূজাতেই সিনেমা হলে যাচ্ছে ব্ল্যাক!শুধু তাই নয়, ব্ল্যাক ছবির নামকরণেও রয়েছে অনিয়ম। চলচ্চিত্র নির্মাণের নতুন আইন মতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে কোনো ছবির ইংরেজি নামকরণ নিষিদ্ধ। সেক্ষেত্রে কালো শব্দের ইংরেজি ‘ব্ল্যাক’ নাম নিয়ে কী করে মুক্তি পাবে এই ছবিটি? আরো মজার ব্যাপার হলো ‘ব্ল্যাক’ ছবির মহরতের সময় এর নাম ছিলো ‘রকেট’। কিন্ত নতুনর নিয়মে ইংরেজি নামকরণ নিষিদ্ধ বলে সেটি বদলে ‘বুলেট’ রাখা হয়। তারপর আবার সেটি বদলে দিয়ে রাখা হয়েছে ‘ব্ল্যাক’! তবে নামকরণে এই পরিবর্তন করে কী বিশেষ সুবিধা বা আইন মানা হলো?এমনই শত প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এই ছবিটি। কিন্তু এর কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি সেন্সর বোর্ড, প্রযোজক সমিতি, পরিচালক সমিতি, শিল্পী সমিতি, পরিবেশক সমিতির সাথে কথা বলে। সবাই কেবল দায় এড়িয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করেছেন।তাই সবকিছু ছাপিয়ে মনে দানা বাঁধছে নতুন চক্রান্তের সন্দেহ। দেশের মানুষের বাঁধার মুখে ভারতীয় ছবি ও সংস্কৃতি আমদানি করতে কিবরিয়া লিপুরা কী নতুন কৌশল ফেঁদেছেন? যদি তাই হয় তবে এর যে নেতিবাচক প্রভাব তার দায় নিতে হবে সেন্সর বোর্ডসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে। কারণ, যদি ভারত বা বিদেশের ছবি রপ্তানী করতেই হয় তবে সেটি হতে হবে সুনির্দিষ্ট নীতিমালায়। কোনো অবৈধ-অন্যায় আশ্রয়ে নয়। তবে যৌথ প্রযোজনা নিয়ে এই অনিয়মের জন্য চলচ্চিত্র বোদ্ধারা দায়ী করছেন আমলাতন্ত্রের চলচ্চিত্র ব্যবস্থাকে। তারা বলেন, সেন্সর থেকে শুরু করে প্রযোজক সমিতিতেও সরকারি আমলারা ক্ষমতায় বসে আছেন। তারা ঢাকাই ছবির ইতহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কেও যেমন সচেতন নন, তেমনি ঢাকাই ছবির নিয়ম-নীতিমালা সম্পর্কেও সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল নন। যদি হতেনই, তবে একের পর এক অনিয়মের সৃষ্টি চলচ্চিত্রাঙ্গনে হতো না। উল্লেখ্য, সম্প্রতি সেন্সরের আইন ও নির্দেশ অমান্য করেই পোস্টারে ‘১৮+’ প্রতীক ব্যবহার করে ‘রানআউট’ ছবির প্রচারণা চালিয়েছেন ছোট পর্দা থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণে আসা তন্ময় তানসেন।  একইভাবে প্রচুর অশ্লীল সংলাপ ও দৃশ্য নিয়েই হলে প্রদর্শিত হয়েছে রকিবুল ইসলামের ছবি ‘নগর মাস্তান’। এই দুটি বিষয়েই সেন্সরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও তারা এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না দিয়ে অনিয়মের দরজা প্রশস্ত করে দিয়েছেন। যে দরজা দিয়ে এবার ঢাকায় মুক্তি পেতে যাতে শতভাগ ভারতীয় চলচ্চিত্র ব্ল্যাক! এলএ/আরআইপি

Advertisement