রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি সরকারি পিএন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজন নিশ্চিন্তে এখানে মেয়েদের পড়তে পাঠান। কিন্তু এই বিদ্যালয়েই দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন নৃশংস হত্যা মামলার আসামি।
Advertisement
বিদ্যালয়টির মালি সুজন আল হাসানের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী এক যুবককে মাথায় ধারালো শাবল ঢুকিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এই ঘটনায় টানা ৮৫ দিন কারাগারেও কাটান মামলার ৩ নম্বর আসামি সুজন।
মামলায় সুজন ছাড়াও আসামি রয়েছেন ২১ জন। তাদের প্রত্যেককেই অভিযুক্ত করে এরই মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু তার এসব খতিয়ান জেনেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই ঘটনায় মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা।
অভিযুক্ত সুজন রাজশাহী নগরীর শাহমখদুম থানার ভুগরইল পশ্চিমপাড়া এলাকার নওশাদ আলীর ছেলে। ২০০৪ সালের অক্টোবরে মালি হিসেবে সরকারি পিএন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি যোগদান করেন। কারাগারে কাটানো দিনগুলো ছুটি দেখিয়ে পার পেয়েছেন সুজন। জামিনে থাকায় এখন নিয়মিত অফিস করছেন।
Advertisement
জানা গেছে, জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে ২০১৯ সালের ৭ জুলাই ভুগরইল পশ্চিমপাড়া এলাকার নিজ বাড়িতে প্রতিবেশীদের নৃশংস হামলার শিকার হন আবদুল হান্নান ও তার ছেলে সেলিম রেজা। এর তিন দিন পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সেলিম।
এই ঘটনায় ওই দিনই ২১ জনকে আসামি করে শাহমখদুম থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের বাবা আবদুল হান্নান। মামলায় ৩ নম্বর এজাহারনামীয় আসামি সুজন আল হাসান। মামলার অন্য আসামিরা তার ভাই, নিকটাত্মীয় ও সহযোগী।
গত বছরের ২২ অক্টোবর মামলায় অন্য আসামিদের সঙ্গে আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন সুজন আল হাসান। পরে আদালত তাদের জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। দীর্ঘ ৮৫ দিন কারাগারে কাটিয়ে এ বছরের ১৬ জানুয়ারি ছাড়া পান সুজন। জামিনে বেরিয়ে এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সুজনসহ অন্য আসামিরা। তাদের অব্যাহত হুমকিতে এলাকা ছেড়েছে নিহতের পরিবার।
মালি সুজন আল হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে শুরু থেকেই নানামুখী তৎপরতা শুরু করেন সুজন। আর তাকে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তৌহিদ আরা।
Advertisement
আরও অভিযোগ উঠেছে, পিএন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নানা অপকর্মের সাক্ষী মালি সুজন। আর তাই সুজনকে বাঁচাতে স্বয়ং প্রধান শিক্ষক তৌহিদ আরা প্রত্যয়ন দিয়েছেন। প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকেও। কারাগাবন্দি এমনকি চার্জশিট দাখিল হলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি।
সুজনকে দেয়া প্রধান শিক্ষকের প্রত্যয়নের কপি এসে পৌঁছেছে জাগো নিউজের হাতে। তাতে সুজনকে মালি পদে কর্মরত দেখানো হয়েছে ২০১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে। হত্যাকাণ্ডের দিন ও পরদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুজন বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে এতে দাবি করেছেন প্রধান শিক্ষক তৌহিদ আরা। গত বছরের ৪ আগস্ট এই প্রত্যয়ন দেন প্রধান শিক্ষক। পরে সেটি থানা-পুলিশ এমনকি আদালতেও যায়।
এদিকে বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের দফতরে পাওয়া যায় সুজন আল হাসানকে। তিনি দাবি করেন, হত্যাকাণ্ডের দিন বিদ্যালয়ে পঞ্চদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। কেবল জুমার নামাজের জন্য বেরিয়েছিলেন। তিনি ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত নন।
তবে সুজন স্বীকার করেছেন, ওই মামলায় তিনি ৮৫ দিন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে কাটিয়েছেন। কারাগার থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন এই বছরের ১৬ জানুয়ারি। এরপর থেকে তিনি অফিস করছেন নিয়মিত। কারাগারে কাটানো দিনগুলো তিনি ছুটি হিসেবেই দেখিয়েছেন। তার সবকিছু ম্যাডাম (তৌহিদ আরা) জানেন।
তবে মামলার তদন্তকামী কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক সেলিম রেজা বলেন, মামলার তদন্তে সুজন আল হাসানের জড়িত থাকার সত্যতা পাওয়া গেছে। ঘটনার দিন জুমার মামাজের পর নিজ বাড়িতে নৃশংসতার শিকার হন সেলিম রেজা। তার বাবা আবদুল হান্নানকেও কুপিয়ে জখম করা হয়। মামলার সাক্ষীরা সুজনসহ অন্য আসামিদের সেখানে হামলা চালাতে দেখেছেন।
তদন্ত শেষে এই বছরের ৯ এপ্রিল মামলার ২১ আসামিকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন তিনি। এর আগে সুজনকে চার্জশিট থেকে বাদ দিতে বিভিন্ন দিক থেকে তার কাছে তদবির এসেছিল। কিন্তু তিনি তা আমলে নেননি বলেও জানিয়েছেন এসআই সেলিম রেজা।
মামলার তদন্তে এসআই সেলিম রেজা গিয়েছিলেন ওই বিদ্যালয়ে। বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রধান শিক্ষক তৌহিদ আরা। তবে আগে সুজনের বিরুদ্ধে মামলা, তার কারাগারে থাকা এমনকি চার্জশিট দাখিলের বিষয়টি সরাসরি জানেন না বলে উড়িয়ে দেন প্রধান শিক্ষক। পরে তিনি দাবি করেন, বিষয়টি সুজন তাকে জানাননি। আদালত থেকেও তাকে জানানো হয়নি। কেবল মামলার তদন্তে এসেছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। জেলে থাকার বিয়ষটিও গোপন করেছেন সুজন। এমনকি প্রত্যয়নও নিয়েছেন তথ্য গোপন করে। তিনি এসবের কিছুই জানেন না। মালিকে মামলা থেকে বাঁচাতে বিভিন্ন মহলে তদবির করার অভিযোগও অস্বীকার করেন তৌহিদ আরা। তবে এখন তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে তা জানাননি প্রধান শিক্ষক।
জানতে চাইলে বিষয়টি তাদের আওতাভুক্ত নয় বলে জানান রাজশাহী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, বিষয়টি আঞ্চলিক শিক্ষা দফতরের উপ-পরিচালকের আওতাধীন। তিনিই বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন।
তবে নাসির উদ্দিন যোগ করেন, এমন ঘটনায় কি সরকারি কি বেসরকারি কারোরই চাকরিতে থাকার সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে আঞ্চলিক শিক্ষা দফতরের উপপরিচালক ড. শরমিন ফেরদৌস চৌধুরী বলেন, ওই ব্যক্তি কারাগারে ছিলেন নাকি ছুটিতে ছিলেন বিষয়টি তার দফতরকে জানায়নি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া তার ছুটি মঞ্জুরের নথিপত্র তার দফতরেও আসেনি। ফলে তারা এনিয়ে কিছুই জানেন না।
এফএ/পিআর