রাজনীতি

হতাশ বিএনপির তৃণমূল

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির পর থেকে দলটির তৃণমূলে চরম হতাশা বিরাজ করছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের ওই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি। নির্বাচিত কয়েকজনের শপথ না নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পরও শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়া, পরবর্তী সময়ে কয়েকটি আসনে উপ-নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকাবস্থায় তার মুক্তির দাবিতে কোনো জোরদার আন্দোলন করতে না পারা এবং সরকারের কৃপায় খালেদা জিয়ার মুক্তির পর তারও নীরবতা, সেই হতাশা আরও ফিকে করেছে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের।

Advertisement

ক্ষুব্ধ কর্মীরা বলছেন, বিএনপি টানা ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে। এমনিতে হতাশার শেষ নেই নেতাকর্মীদের মধ্যে, এর ওপর আবার হাইকমান্ড কোনো যুৎসই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বা সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি। বরং তারা দলের তৃণমূলের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে যাচ্ছে নানাভাবে।

তৃণমূল পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের পরপরই অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচন বর্জন করলেও পরবর্তী সব উপ-নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। মূল নির্বাচনে মাঠ ছেড়ে দিয়ে উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণের এই দ্বিমুখী সিদ্ধান্ত তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রচণ্ডভাবে হতাশায় ফেলেছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করেন, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের একটি অংশ সরকারের সঙ্গে আঁতাত করেছে। সরকারের মেয়াদ পূর্ণ করার জন্যই তারা এ ধরনের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।

তৃণমূলের অনেক নেতা মনে করেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যানের পর নির্বাচিত চারজনের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিএনপি তার নৈতিক অবস্থান ও রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। নির্বাচিতদের যদি শপথই করতে বলা হবে, তাহলে বিএনপি নির্বাচন কেন বর্জন করল, সে প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজছেন অনেকে। আবার নির্বাচিত পাঁচজনের মধ্যে চারজনকে সংসদে পাঠিয়ে কেবল মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে কেন শপথ করতে দেয়া হলো না, সে প্রশ্নের জবাবও খুঁজছেন অনেকে। কারও কারও মতে, নির্বাচিতদের শপথের মাধ্যমে সংসদে পাঠিয়ে মূলত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে বৈধতা দিয়ে দেয়া হয়েছে।

Advertisement

বিএনপির মধ্যম পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একাদশ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করলেও পরবর্তী যে ক’টি আসনে উপ-নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে কেবল মির্জা ফখরুলের ছেড়ে দেয়া আসন (বগুড়া-৬) ছাড়া আর কোনোটিতে কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি বিএনপি। হতাশ নেতাকর্মী ও ভোটারদের তারা ভোটকেন্দ্রমুখীও করতে পারেনি। মূল নির্বাচনে ভরাডুবির হতাশা আরও চেপে ধরছে এসব উপ-নির্বাচনের নেতিবাচক ফলাফল।

এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দি থাকলেও তার মুক্তির দাবিতে সারাদেশে কোনো কর্মসূচি পালন করতে না পারা, করোনা সঙ্কটকালে সরকারের অনুকম্পায় খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং পরবর্তীকালে তার নীরবতা দেখে তৃণমূলের কর্মীরা বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করছেন।

উপ-নির্বাচন ঘিরে অসন্তোষ-অভিযোগ

গত ৭ সেপ্টেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমাদের বরাবরই সিদ্ধান্ত ছিল নির্বাচনে অংশ নেয়ার। শুধু করোনার কারণে আমরা গত দুটি উপ-নির্বাচনে (যশোর ও বগুড়া) যোগ দিয়েও পরবর্তীতে প্রচারণায় যাইনি, সরে দাঁড়িয়েছি। আগামীতে আমরা উপজেলা নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করব, সেই সিদ্ধান্তই আছে।

Advertisement

এদিকে উপ-নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের দিকে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করেন, এসব উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণের আড়ালে মনোনয়ন বাণিজ্য চলছে, যা দলের জন্য আত্মঘাতী। এতে দলের চরম ক্ষতি হচ্ছে। যা থেকে বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর আশা আরও ক্ষীণ হচ্ছে।

উপ-নির্বাচনে মনোনয়ন সংক্রান্ত সর্বশেষ বৈঠক চলাকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে মনোনয়নপ্রত্যাশী সমর্থকদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনা নিয়েও তৃণমূলে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মনোনয়ন গ্রহণকালে শোডাউনের সময় কর্মী-সমর্থকদের দেখা গেলেও আন্দোলনের মাঠে কেন তাদের পাওয়া যায় না, সে প্রশ্ন যেমন উঠেছে; তেমনি অনেকের প্রশ্ন, এই শোডাউনবাজদের মনোনয়ন দিয়ে দলের কী লাভ হবে?

এ প্রসঙ্গে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপির মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণেই নির্বাচন এলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেড়ে যায়। কখনও কখনও তা রূপ নেয় সংঘর্ষে। সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত রাখতে অনৈতিক পথ থেকে বের হয়ে আসতে হবে বিএনপিকে।’

‘অর্থের বিনিময়ে প্রার্থিতা দেয়ার সংস্কৃতি বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে’ মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘যা রটে তার কিছু তো বটে। কিছু না হলে এটা রটবে কেন? গণতন্ত্রের চর্চা না থাকার কারণে এটা হচ্ছে।’

অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কমিশনার নবী উল্লাহ নবী একাদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৫ আসন থেকে নির্বাচন করেন। ঢাকায় বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি ভোট পান। তবে ওই আসনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের হাবিবুর রহমান মোল্লা। সম্প্রতি তার মৃত্যুতে শূন্য হওয়া এ আসনে আসন্ন উপ-নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাননি নবী। সাবেক সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন আহমদকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছে বিএনপি

মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার তিনদিন পর নিজের ফেসবুক পোস্টে নবী উল্লাহ উল্লেখ করেন, ‘বিএনপির বড় সারির অনেক নেতা সরকারি এজেন্টদের ফাঁদে এমনভাবে পা দিয়েছেন, মনে হচ্ছে বিএনপির এসব এজেন্টের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ একের পর এক সরকারের এজেন্ডা বিএনপিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে। তাহলে কি এটা দেখার কেউ নেই?’

তিনি আক্ষেপ করে আরও লেখেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীদের এত পরিশ্রম, জেল, জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, গুম, ত্যাগ কি বৃথা যাবে? তাহলে কি আমরা বিএনপির বিজয় দেখে যেতে পারব না? হয়তো একদিন সরকারি এজেন্টদের পতন হবে, একদিন বিএনপির বিজয় হবে। ততদিনে আমরা অনেকেই বেঁচে নাও থাকতে পারি।’

অপরদিকে ঢাকা-১৮ আসনের উপ-নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী এস এম জাহাঙ্গীরকে নিয়েও স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। ওই এলাকা থেকে যারা বিএনপির হয়ে কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন এমন আটজন জাহাঙ্গীরকে মনোনয়ন না দেয়ার জন্য দলীয় হাইকমান্ডের কাছে লিখিত আবেদন করেন। এর কিছুদিন আগে ছাত্রদলের কর্মীরা জাহাঙ্গীরকে লাঞ্ছিতও করেন। অবশ্য, জাহাঙ্গীরের জন্য মনোনয়ন চেয়ে তারাও দলীয় হাইকমান্ডের কাছে আবেদন করেন।

কেএইচ/এইচএ/এমএআর/পিআর