জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা এবং গ্রামীণ সর্বস্তরের মানুষের কাছে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু হয় কমিউনিটি ক্লিনিকের। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে তার উল্টোটা। এমনকি কিছু কিছু কমিউনিটি ক্লিনিকে নামে মাত্র সেবা দেয়া হচ্ছে। রোগীরা অভিযোগ করে বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সহকারী (এইচএ), ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার সহকারী (এফডব্লিউএ) ও কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) নিজেরাই ওষুধ ও পরামর্শ দিচ্ছেন। রাজবাড়ীর বেশ কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিক ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।রাজবাড়ী সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজবাড়ীর পাঁচটি উপজেলায় ১৩৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে সদরে ৩৪, গোয়ালন্দে ১৩, বালিয়াকান্দিতে ২৩, কালুখালীতে ২২ ও পাংশা উপজেলায় ৪১টি রয়েছে। আরো জানা যায়, প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ১জন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি), ১ জন স্বাস্থ্য সহকারী (এইচএ), ১জন ফ্যামিলি ওয়েল ফেয়ার সহকারী (এফডব্লিউএ) রয়েছেন। যারা সদর হাসপাতালে ৩ মাস প্রশিক্ষণের পর কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে রোগীদের সেবা ও ওষুধ দিচ্ছেন।স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকাল ৯টায় ক্লিনিক খোলার কথা থাকলেও সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার দিকে তা খোলা হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্লিনিকগুলো বেলা ২টার দিকে বন্ধ করে চলে যায় বলে জানা গেছে। তবে জেলার প্রতিটি ক্লিনিকে রোগীদের উপস্থিতি ভাল বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ জন রোগী প্রতিদিন চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন।এদিকে রোগীদের অভিযোগ, ক্লিনিক থেকে তাদের সাধারণ রোগের ওষুধ দিলেও জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা দেয়া হয় না। এজন্য তাদের সদর হাসপাতাল বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হয়।জেলা সদরের ব্রাহ্মণদিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, সুভা বেগম (৯২) নামে এক নারী চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তিনি জানান, তার বয়স হয়েছে। তাই প্রায় এখানে চিকিৎসা ও ওধুষ নেয়ার জন্য আসেন। এখানে যারা কাজ করেন সকলেই তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেন এবং চিকিৎসা সেবা দিয়ে ওষুধ দেন। এদিকে ব্রাকের স্বাস্থ্যকর্মী সুফিয়া বেগম (৩৮) জানান, এই এলাকায় তিনি নিয়মিত আসা যাওয়া করেন। ক্লিনিকে ভাল চিকিৎসা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ওষুধ দেয়া হয়। সময় মতো তারা ক্লিনিকে আসে আবার সময় মত চলে যায়।অপরদিকে জেলা সদরের মহিষাখোলা কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, জাহাঙ্গীর মোর্তজা (৩৫) নামে এক ব্যক্তিকে কুকুরে আচড় দিয়েছে বলে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তিনি জানান, আমাকে কুকুর আচড় দিয়েছে তাই কোনো জীবাণু আছে কিনা এই ভয়ে স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করতে এসেছি। তাছাড়া এরা নিয়মিত এলাকাবাসীকে সেবা দিচ্ছে। এতে আমরা খুশি। তবে বিশেষজ্ঞ ডা. ক্লিনিকে থাকলে আমাদের জটিল রোগের চিকিৎসা নিতে সুবিধা হতো। গোয়ালন্দ উপজেলার কয়েকটি ক্লিনিক ঘুরে দেখা যায় ঠিক একই চিত্র । তবে ক্লিনিক খোলা ও বন্ধ করার সময়টা নিয়ে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।পাংশা উপজেলার সড়িষা ইউনিয়নের বাগলী কমিউনিটি ক্লিনিকের গিয়ে কথা হয় ঝর্না বেগম (২৭) এর সঙ্গে। তিনি তার ও মেয়ের চিকিৎসার জন্য এসেছেন। তিনি বলেন, আমরা গরীব মানুষ। ভাল ডাক্তরের কাছে যেতে পারি না। তাই এখানে আসি। তবে উনারা আমাদের কথা শুনে ওষুধ দেন। কোনো পরীক্ষা করেন না।অন্যান্য উপজেলার ক্লিনিকের রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা ক্লিনিকে গেলে চিকিৎসা ঠিকই দেয়। কিন্তু শুধু জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে তা শুনেই ওষুধ দেয়। তবে বেশির ভাগ রোগীকে নাপা, প্যারাসিটামল, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি ধরনের ওষুধ দিয়ে থাকে। রোগীদের দাবি ক্লিনিকগুলোতে বিশেষজ্ঞ ডা. নিয়োগ করার এবং কঠিন ও জটিল রোগের চিকিৎসা দেয়াসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের ওষুধ দেয়া। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বাস্থ্য সহকারী জানান, আমরা সপ্তাহের ৬ দিন সকাল ৯টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ক্লিনিক খোলা রাখি এবং সপ্তাহের প্রতিদিন জনগণকে স্বাস্থ্য শিক্ষা দেয়া, সপ্তাহের দুইদিন ইপিআই কার্যক্রম, মাসে মেইন গ্রুপের একবার মিটিং করা হয়। তিনি জানান, ৩১ ধরনের ওষুধ দেয়া হয় ক্লিনিক থেকে। আমাদের ৩ মাস প্রশিক্ষণ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা রোগীদের চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ দেই। ২ থেকে ৩ দিনের বেশি কোনো রোগীকে ওষুধ দেয়া হয় না। আর রোগীদের কাছ থেকে যে ২ টাকা করে নেয়া হয় তা দিয়ে বিদ্যুৎ বিল ও আয়ার বেতন দেয়া হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ক্লিনিকগুলোতে ওষুধ পান তারা। তবে জটিল ও কঠিন রোগের রোগীরা আসলে হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে তিনি জানান। এ সকল বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হয় রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহবুবুল হকের সঙ্গে। তিনি ব্যস্ত থাকায় তার পক্ষে কথা বলেন সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. আসিফ মাহমুদ।তিনি বলেন, জেলায় ১৩৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সকল ধরনের স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু অভিযোগ আছে। ক্লিনিকে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে না বা কোনো কোনো সময় তারা সঠিক সময় সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমাদের রাজবাড়ী জেলার স্বাস্থ্য প্রশাসন অত্যন্ত কঠোরভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং এই ক্ষেত্রে যা যা করণীয় দরকার সে সব বিষয় সিভিল সার্জন সফলতার সঙ্গে পালন করছেন।এসএস/পিআর
Advertisement