যে কোন দেশ ও জাতির মন ও মনন তৈরি হয়ে ওঠে তার শিক্ষাব্যবস্থার হাত ধরে। গুণগত ও মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রধানত দুটো দিক থাকে। একটা হচ্ছে - এটা মানুষকে সত্যিকারের উদার, মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে- শিক্ষালাভ শেষে যেন সেটাকে কাজে লাগিয়ে নিজের রুটিরুজির ব্যবস্থা করে নিতে পারে।
Advertisement
বর্তমান বিশ্ব পরিবর্তিত হচ্ছে খুব দ্রুত গতিতে। তথ্যপ্রযুক্তির শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি এ পরিবর্তনকে অবারিত ও অবধারিত করে তুলেছে।আমাদেরকে সেই অবস্থা অনুধাবন করে শিক্ষাব্যবস্থাকে গতিশীল ও যুগোপযোগী করে তুলতে হবে। উদার, মানবতাবাদী মানুষ হওয়ার শিক্ষাটা যেমন সে এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে লাভ করবে একইসাথে কর্মমুখর জীবনে গিয়েও তার অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞানকে যেন কাজে লাগাতে পারে। পরনির্ভরতা কাটিয়ে নিজে কিছু করতে পারে।
এজন্য আমাদেরকে নৈতিক, মানবিক শিক্ষার সাথে কর্মমুখী শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে- কিন্তু সেখানে সেই গতানুগতিক বিষয়ই পড়ানো হচ্ছে।অথবা যা পড়ানো হচ্ছে দেখা যাচ্ছে কর্মক্ষেত্রে গিয়ে এ তাত্ত্বিক শিক্ষার কোনো ব্যবহারিক ভিত্তিই থাকছে না। এদিকে গতানুগতিক বিষয় থেকে পাস করার পরে ছেলে-মেয়েরা উপায়হীন হয়ে শুধু সরকারি চাকরির জন্য কাকপক্ষীর মতো তাকিয়ে থাকে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এসব বিষয়ের সংগত কারণেই তেমন চাহিদা থাকে না। ফলে আমাদের এখানে কথিত শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অথচ এদেরকে কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে রাষ্ট্র বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারত।
একটু উদাহরণ দিলে মনে হয় বিষয়টা আর একটু খোলাসা হতে পারে। যেমন ধরুন-আমাদের গার্মেন্টস সেক্টর থেকে আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছি। এর সাথে আছে আমাদের প্রবাসী জনশক্তির পাঠানো রেমিটেন্স। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে বেশি বেতনে কাজ করছে কিন্তু বিদেশী লোকজন। আবার প্রবাসে যারা যাচ্ছেন রেমিটেন্স যোদ্ধা হিসেবে তারা অধিকাংশই দক্ষ জনশক্তি নন। ফলে তারা বাইরে গিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করে বটে তবে সে অনুযায়ী বেতন পান না। অথচ তারা যদি দক্ষ শ্রমিক হিসেবে যেতে পারতেন তাহলে একই পরিশ্রমে আরো বেশি পরিমাণে অর্থ উপার্জন করতে পারতেন।
Advertisement
তাই বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। উন্নত দেশের উদাহরণ দেখেন। তাদের ওখানে যে কোন পেশাতেই ঢুকতে গেলে আগে ট্রেনিং নিতে হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত হয়েই তারপর এসব কাজ শুরু করতে পারে। এজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে "ট্রেড কোর্স" চালু করেছে তারা। রান্নাবান্না, চুল কাটা, পেইন্টিং, ড্রাইভিং থেকে শুরু করে সব কিছুতেই এসব কোর্স চালু আছে। এ রকম সব পেশার তালিকা করে আমরাও যদি বিদেশগামী এবং দেশে যারা এসব পেশায় আগামীতে কাজ করবে তাদেরকে যথাযথ ও গুণগত মানসম্পন্ন তাত্ত্বিক ও প্রাকটিক্যাল শিক্ষাটা দিতে পারি তাহলে এর সুফল দুই দিক থেকে পেতে পারি। (এক) যারা যে পেশা বেছে নিচ্ছেন তার এর সেফটি, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, এ থেকে প্রটেকশান নেয়া, কাস্টমার ডিলিংস,কাস্টমারের স্বাস্থ্য সুরক্ষা( খাবার তৈরি, বিউটি পারলার, চুল কাটা ইত্যাদি এরকম কাজে যারা জড়িত) এসব নিয়ে এরা শুরু থেকেই ওয়াকিবহাল থেকে কাজ শুরু করতে পারে। (দুই) কাস্টমারও নিশ্চিন্ত মনে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া ও অন্য সেবা নিতে পারবে। এতে করে সার্বিক লাভই বেশি হবে আমাদের। না জেনে বুঝে শুধু দেখে দেখে যারা এসব কাজে নামছে তাদের এসব ঝুঁকি নিয়ে ভাবার কোন দায় থাকে না। তারা কাস্টমার ডিলিংসটাও বুঝে না। পেশাটাকে সেভাবে তারা উপভোগও করে না।
এজন্য প্রয়োজন শুধু গতানুগতিক বিষয়কে সীমিত করে দিয়ে কারিগরি শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও প্রাকটিক্যাল ভিত্তিক করে (তাত্ত্বিক শিক্ষার সাথে সাথে ফিল্ডে কাজ করার শিক্ষাসূচি ও কাঠামো তৈরি) সাজানো।সেই সাথে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এ সংক্রান্ত উচ্চতর কোর্স চালু করা উচিত।দেশে ও বিদেশে কেমন জনশক্তির চাহিদা আছে, ভবিষ্যতে কেমন হতে পারে সেটাকে সবসময় মনিটরিং করা, সে লক্ষ্যে সিলেবাস প্রনয়ন করা সহ আনুসঙ্গিক কাজ করার জন্য আলাদা সেল তৈরি করা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও যৌক্তিক কাজ বলে আমার মনে হয়।
এ লক্ষ্যে প্রথমেই দেশে চলমান সকল পেশার তালিকা তৈরি করা উচিৎ। তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী ৬/১২ মাস বা বিভিন্ন মেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। দরকার হলে তালিকা করে বলে দিতে হবে যে এ সকল পেশায় আগামীতে নির্ধারিত প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ ঢুকতে পারবে না। লাগলে এজন্য আইন প্রনয়ন করতে হবে।মনিটরিং করতে হবে। তাতে করে দেশের সকল পেশাগত সেক্টরে আলাদা আলাদাভাবে কত মানুষ কর্মরত আছে তা আমরা চোখ বুঁজে বলে দিতে পারব। চাইলে সরকার এখান থেকে রাজস্বও আহরণ করতে পারবে। কাস্টমাররাও সন্তুষ্ট মনে সেবা নিতে পারবে।
বিদেশের মতো দেশেও কোন পেশাই তখন আর ছোট থাকবে না।সব পেশাই সম্মানজনক পেশা হিসেবে বিবেচিত হবে। অহেতুক কোন পেশাকে হেয় করে দেখার আমাদের যে সেকেলে মানসিকতা আছে তাতেও পরিবর্তন আসবে। ফলে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীর আর্থিক নিশ্চয়তার পাশাপাশি মানসিক শান্তিও আমরা নিশ্চিত করতে পারব।
Advertisement
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগএনাম মেডিকেল কলেজ।
এইচআর/জেআইএম