তিন শিশুসন্তান নিয়ে অকূল পাথারে পড়েছেন রাজশাহীর পুঠিয়ায় গণপিটুনিতে নিহত ট্রাকচালক আবু তালেবের স্ত্রী নারগিস বেগম। সন্তানদের পড়ালেখা এমনকি তাদের মুখের খাবার জোগাড় নিয়েই চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন অকাল বিধবা এই নারী।
Advertisement
নিহত আবু তালেব পুঠিয়া উপজেলার ঝলমলিয়া এলাকার বাসিন্দা। বিয়ের পর থেকে তিনি শ্বশুরের দেয়া সামান্য জমিতে কুঁড়েঘর তুলে স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ৯টার দিকে জেলার বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ থেকে পণ্যবোঝাই ট্রাক নিয়ে পুঠিয়ার দিকে আসছিলেন আবু তালেব। পথে তাহেরপুর এলাকায় আসামাত্র ট্রাকের চাপায় একটি ছাগল মারা যায়। এরপর ওই এলাকার ২০-২৫ জনের একটি দল মোটরসাইকেলে ট্রাকটি ধাওয়া করে বাসুপাড়া এলাকায় আটক করে। পরে তারা চালক আবু তালেবকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। স্থানীয় লোকজন ট্রাকচালককে মুমূর্ষু অবস্থায় পুঠিয়া হাসপাতালে ভর্তি করলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন। পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে।
এ ঘটনায় মুষড়ে পড়েছে ট্রাকচালক আবু তালেবের পরিবার। কিছুতেই তারা এ ঘটনা মানতে পারছে না। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অকূল পাথারে পড়েছে পুরো পরিবার। এখনও এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ায়নি কেউই।
Advertisement
নিহত আবু তালেবের স্ত্রী নারগিস বেগম বলেন, তিনি (আবু তালেব) খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন। প্রতি মাসে চারবার ট্রাক নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেতেন। ছেলে-মেয়ের কথা মনে পড়লেই দু-তিন দিনের মধ্যে আবার বাড়ি চলে আসতেন।
বড় মেয়ে উষা খাতুন (১১) ঝলমলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে ইতি এ বছর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। সবার ছোট ছেলে ইসরাফিলের বয়স মাত্র ১১ মাস।
নারগিস জানান, বাড়িতে ফিরলে তিনি সারাক্ষণ বাচ্চাদের বায়না মেটানো ও তাদের সঙ্গে খেলা করে সময় পার করতেন। ঘরে দু’বেলা খাবার না থাকলেও তিনি সন্তানদের কখনও অভাব বুঝতে দেননি। এখন আমি সংসার চালাব কীভাবে?
তিনি আরও জানান, প্রায় এক সপ্তাহ আগে বাড়ি ছেড়েছিলেন আবু তালেব। শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি ফোনে সন্তানদের বলেছেন রাতে বাড়ি আসবেন। পরের রাতেই তিনি বাড়িতে এসেছেন ঠিকই তবে লাশ হয়ে।
Advertisement
যখন মরদেহ বাড়িতে নেয়া হয় তখন বড় মেয়ে শেষ দেখা দেখতে পেয়েছে বাবাকে। ছোট মেয়ে ও একমাত্র ছেলে ঘুমিয়ে ছিল। বাবাকে আর শেষ দেখা হয়নি তাদের। চারদিন ধরে ছোট মেয়েটা বাবার অপেক্ষায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। সে এখনও বুঝতে পারছে না তার বাবা আর কখনো ফিরে আসবে না। ছেলের তো এখনও কোনো অনুভূতিই হয়নি। এই শিশুদের নিয়ে আমি এখন কোথায় যাব। কী করবো? আমার চারদিকে শুধু অন্ধকার হয়ে আসছে।
নিহত আবু তালেবের সহকারী সিপন আলী বলেন, ভবানীগঞ্জ থেকে ট্রাকে মাল নিয়ে আমরা পুঠিয়ার দিকে আসছিলাম। পথে তাহেরপুর পৌঁছানোর একটু আগে অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটি ছাগল ট্রাকের ঠিক দু’হাত সামনে দিয়ে দৌড় দেয়। যে মুহূর্তে ছাগলটি দৌড় দিয়েছে সে সময় কোনো চালকের পক্ষে একটি মালবোঝাই ট্রাক তৎক্ষণিক দু’হাত দূরত্বের মধ্যে ব্রেক করা সম্ভব নয়।
সিপন জানান, আমরা ছাগলটির মূল্য দিতে রাজি ছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে উত্তেজিত হতে থাকে। একপর্যায়ে আমরা গাড়ি নিয়ে পুঠিয়ার দিকে রওনা হই। তখন ওই এলাকার ২০-২৫ জন লোক মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের পেছনে ধাওয়া করে বাসুপাড়া এলাকায় ঘিরে ধরে। পরে তারা চালককে লাঠিসোটা দিয়ে গণপিটুনি শুরু করে। তাদের হাত থেকে পালিয়ে আমি প্রাণে রক্ষা পেলেও আবু তালেব ভাইকে তারা পিটিয়ে হত্যা করে।
নিহত আবু তালেবের প্রতিবেশী ও পুঠিয়া পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু বাক্কার বলেন, নিহত ট্রাকচালক আবু তালেব সম্পর্কে আমার ভাতিজি জামাই। তিনি প্রায় ১৫ বছর আগে ঝলমলিয়া গ্রামের মৃত তমিজ উদ্দীনের মেয়ে নারগিস বেগমকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে তিনি শ্বশুরের দেয়া সামান্য জমিতে ছোট একটি ঘর তুলে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বসবাস করতেন। তিনি আমাদেরসহ এলাকার অনেকের ট্রাকের ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেছেন। কখনো তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। অথচ এ রকম একজন মানুষকে কী নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে! এখন তার স্ত্রী ছোট তিনটা বাচ্চা নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, আবু তালেব অন্যায় করলে তারা মামলা করতে পারত বা তাকে ধরে পুলিশে দিতে পারত। এমন অমানবিক কাজ তারা কীভাবে করলো?
রাজশাহী জেলা সড়ক পরিবহন ও শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান পটল বলেন, ট্রাক ড্রাইভার আবু তালেব আমাদের ইউনিয়নের সদস্য। তার বিরুদ্ধে এ যাবত কোনো অভিযোগ বা অনিয়মের ঘটনা নেই। কিন্তু তার ওপর যে অমানবিকতার ঘটনা ঘটেছে তা কোনো সভ্য সমাজ মেনে নেবে না।
তারা শুধু আবু তালেবকেই পিটিয়ে হত্যা করেছে তা নয়, সাথে ছোট তিন সন্তানসহ পুরো পরিবারকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নিহতের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি ওই পরিবারকে এককালীন কিছু সহায়তা করা হবে।
এফএ/জেআইএম