মতামত

বাসযোগ্য দেশ গড়তে বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই

গোপাল অধিকারীপরিবেশ বাঁচাতে চাই বৃক্ষরোপণ, বৃক্ষ পরম বন্ধু, পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপণ অপরিসীম, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণ অপরিহার্য। পৃথিবীর সকল কিছুর বিকল্প আছে কিন্তু বৃক্ষের বিকল্প আছে কি না একবার ভেবে দেখছেন কি? বৃক্ষের বিকল্প কি তৈরি করছে বা তৈরি হয়েছে? হয়নি আর হবেও না। আমাদের বাড়ি করা দরকার, জায়গা সংকট পাশের গাছটি নির্বিচারে কেটে ফেলছি। বাড়ি বড় করছি কিন্তু বাড়িতে আলো-বাতাস আসবে কি না, বাসযোগ্য হবে কি না তা কিন্তু ভাবি না।

Advertisement

এভাবেই পাল্টে যাচ্ছে বাংলাদেশের চিরসবুজ চেহারা। অবস্থাটা এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে, এশিয়ার যেসব দেশে বনাঞ্চল সবচেয়ে কম সে তালিকায়ও ঢুকে গেছে বাংলাদেশের নাম। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রস্তুতকৃত তালিকায় বলা হয়েছে, এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বনাঞ্চল লাওসে। সেদেশের মোট আয়তনের ৯২.৭ শতাংশই বনাঞ্চল। এরপরই রয়েছে ভুটান, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া। এশিয়ায় সবচেয়ে বনাঞ্চল কম পাকিস্থানে। এ দেশটির আয়তনের মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ বনাঞ্চল। কম বনাঞ্চলের দিক থেকে মঙ্গোলিয়ার স্থান দ্বিতীয়। তারপরই বাংলাদেশের স্থান। জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, প্রতিটি রাষ্ট্রে মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকতে হবে। অথচ এ দেশের ১১ পয়েন্ট ২ শতাংশ মাত্র বনভূমি।

দেশে গত ১৮ বছরে উজাড় হয়ে গেছে প্রায় তিন লাখ ৭৮ হাজার একর বনভূমি, যা মোট বনভূমির প্রাায় ৮ ভাগ। ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বনভূমি উজাড়ের এই তথ্য এসেছে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ বনভূমি উজাড় হয়েছে শেষ পাঁচ বছরে। ফলে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

গাছ আমাদের পরম বন্ধু। গাছের প্রয়োজনীয়তা সকল ভাবেই। গাছের তৈরি অক্সিজেন গ্রহণ করেই আমরা বেঁচে আছি। ফুলের সৌন্দর্য মনকে প্রফুল্ল করে। ফল মানুষের পুষ্টি জোগায়। বৃক্ষ আমাদের ছায়া দেয়। অকাজের গাছটিও জ্বালানি হিসেবে মানুষের উপকারে আসে। শিল্পের নানা উপাদান হিসেবে গাছ ও তার ফল ব্যবহার হয়। গাছের সীমাহীন গুরুত্ব সত্ত্বেও আমাদের বনগুলোর অবস্থা আজ হতাশাজনক। বিখ্যাত সুন্দরবন আমাদের গর্ব। কিন্তু এখন আর সুন্দরবনের সেই সৌন্দর্য নেই। ভাওয়ালের শাল-গজারির বন ধ্বংসের পথে। মধুপুর আর সিলেটের বনের অবস্থাও ভালো নয়। পাবর্ত্য জেলাগুলোর বনের অবস্থা কারও অজানা নয়। র্নিবিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে পাহাড়ধস ও নদী ভাঙনের ঘটনা, ধ্বংস হচ্ছে বসতবাড়ি, প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। এভাবে বাংলাদেশ হারাতে বসেছে তার চিরচেনা রূপ।

Advertisement

গত চার দশকে বাংলাদেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে ব্যাপকভাবে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেভাবে বন উজাড় হয়েছে তা উদ্বেগজনক। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে পার্বত্য বনাঞ্চলে প্রবেশ করে বন উজাড় করে বসতবাড়ি গড়ে তুলেছে। তারা জ্বালানি ও জীবন নির্বাহের জন্য কী পরিমাণ বৃক্ষনিধন করছে তা কল্পনার বাইরে। তাই চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনের অবস্থাও করুণ। অথচ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মোকাবিলায় বনাঞ্চল গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বর্তমানে বাংলাদেশে বর্ষাকাল বিরাজ করলেও প্রাকৃতিকভাবে সূর্যের প্রখর তাবদাহে প্রকৃতি এক ভয়াল মূর্তি ধারণ করেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ফলে প্রকৃতিও বিরূপ আচরণ করে যার পরিণাম হল বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বর্তমানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকছে প্রায় প্রতিদিনই। জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ বৃক্ষ নিধন। বনভূমি উজাড়ের ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে আর কমছে অক্সিজেনের পরিমাণ। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চলের বরফ এবং বাড়ছে সমুদ্রের উচ্চতা। ধেয়ে আসছে জলোচ্ছ্বাস, তলিয়ে যাচ্ছে নিম্নাঞ্চল। নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।

বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে এর প্রভাব মারাত্মকভাবে পড়েছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, ঝড়, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ফণীর ছোবল থেকে আমাদের অনেকাংশে রক্ষা করেছে সুন্দরবন। এ থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, বনভূমির গুরুত্ব কতটা।

বন অধিদপ্তরের তিন বছর ধরে চালানো এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে আশাজাগানিয়া চিত্র। 'বাংলাদেশের বনভূমি ও বৃক্ষ সম্পদ সমীক্ষা প্রতিবেদন-২০১৯' অনুযায়ী, দেশে বনের বাইরে ও ভেতরে গাছের সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বনের বাইরের গাছ। বনভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে সুন্দরবন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বন আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভূমির ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। এর আগে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, এটি ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ।

Advertisement

বনভূমি বাড়াতে সরকারের নেওয়া সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হলো 'টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল)' প্রকল্প। এর অধীনে দেশে বনায়ন শুরু হয়েছে, যা ২০২৩ সাল পর্যন্ত চলবে। তবে সরকারের কোন উদ্যোগই সফল হবে না আমরা যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করি। সত্যিকার অর্থে বৃক্ষরোপণের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে গাছ লাগাতে হবে নিজের স্বার্থে ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে। বর্ষা মৌসুমে বৃক্ষরোপণে সরকারি উদ্যোগে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সব পেশাজীবী মানুষের মধ্যে বৃক্ষরোপণকে একটি কার্যকর আন্দোলন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা, বিজ্ঞানভিত্তিক সামাজিক উন্নত নার্সারি সৃজন এবং সবার আন্তরিকতাই পারে আমাদের কাঙ্খিত অরণ্য ফিরিয়ে দিতে। সেই সাথে শুধু ব্যবসায়ী মনোভাব নিয়ে বিদেশি গাছ না লাগিয়ে আমাদের ঐতিহ্যের ধারক বাহক দেশি আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু গাছ লাগাতে উৎসাহী করতে হবে। কারণ এসব বিদেশি গাছের ভিড়ে এতে শুধু দেশি ফলদগাছই হারাচ্ছে তা নয়, পরিবেশ প্রকৃতির ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। দেশের জীববৈচিত্র্যের জন্যও দেখা দিচ্ছে মারাত্মক হুমকি। মানব দেহের জন্যও বিদেশি গাছ ক্ষতিকর বলে মনে করছেন প্রাণীবিদ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, ব্যাপক হারে বিদেশি গাছ লাগানোর ফলে একদিকে দেশি পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীর খাদ্যসংস্থান কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে মানব স্বাস্থ্যের জন্য সেগুলো ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ ছড়াচ্ছে। তাছাড়া এসব বিদেশি গাছ প্রচুর ভূগর্ভস্থ পানি শোষণ করে পানির স্তর আরও নিচে নামিয়ে দিচ্ছে।

বৃক্ষ বিলুপ্ত হলে আমার আমাদের জীবন-যাপনের শ্বাসকার্য চালাতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাব না, অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মরে যাবে এই চরম সত্যটি উপলব্ধি করে হলেও আমাদের বেশি বেশি বৃক্ষরোপন করা দরকার। কারণ আমরা করোনাকালীন সময়ে দেখেছি অক্সিজেন কতটা প্রয়োজন বা অক্সিজেনের অভাব কতটা অসহায় করে তোলে?

এই একমাত্র কারণটি ছাড়াও বৃক্ষ আমাদের কতটা প্রয়োজ্য তা অযোগ্য ছাড়া যোগ্যদের বোঝাতে হবে বলে আমার মনে হয় না। তাই সচেতনদের বলব, বাঁচান বৃক্ষ, লাগান বৃক্ষ। বাসযোগ্য রাখুন বাংলাদেশ ও গোটা বিশ্ব। আর সরকারকে বলব দেশি বৃক্ষরোপনে উৎসাহ, সচেতনতা, সহযোগীতা ও আইন কঠোর বলবৎ রাখুন ও সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ সতেজ রাখুন ।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম