ময়মনসিংহ জেলার বেশির ভাগ কমিউনিটি ক্লিনিক তালাবদ্ধ থাকায় তৃণমূলের মানুষরা উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নির্ধারিত সময়ে ক্লিনিক না খোলা এবং সার্ভিস প্রোভাইডারদের উপস্থিতি কম থাকাসহ ওষুধ স্বল্পতায় অধিকাংশ স্থানেই রোগীরা নিরাশ হয়ে ঘুরে যাচ্ছেন। হতদরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক দেখাশোনার জন্য ১৭ সদস্যের কমিটি থাকলেও স্বজনপ্রীতি আর ‘ম্যানেজ’ প্রক্রিয়ায় ভেস্তে যাচ্ছে সরকারের এই বিশাল প্রকল্প। কোথাও কোথাও বরাদ্দকৃত যত সামান্য ওষুধপত্রও ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী অথবা কমিটির সদস্যদের মাঝে। এ ব্যাপারে ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন ডা. একেএম মোস্তফা কামাল জানান, ময়মনসিংহ জেলার ১৩টি উপজেলায় ৪৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রতিমাসে দুই লক্ষাধিক রোগীর চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। ময়মনসিংহ সদর উপজেলায় ও ভালুকা উপজেলার বেশ কিছু সংখ্যক ক্লিনিকের অবস্থা খুবই নাজুক। সিভিল সার্জন জানান, জেলায় আরো ৫৮৪টি ক্লিনিক করার প্রক্রিয়া চলছে। ওষুধ সংকটের বিষয়ে বলেন, জেলায় কোনো ওষুধ সংকট নেই। তবে প্রক্রিয়ার কারণে ওষুদ ক্লিনিকগুলোতে পৌঁছাতে বিলম্ব হয়।গ্রামের সাধারণ মানুষের দাবি, শুধু প্যারাসিটামল, ক্যালসিয়াম অথবা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দিয়ে নয়, কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বপ্রাপ্তদের যথাসময়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সাধারণ রোগের প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবার মান নিশ্চিত করা হোক। সরেজমিনে জেলার সদর উপজেলা, হালুয়াঘাট, ফুলপুর, তারাকান্দা, গৌরীপুর, ত্রিশাল, মুক্তাগাছা ও ফুলবাড়ীয়া উপজেলার প্রধান সড়কের পাশে অথবা প্রত্যন্ত অঞ্চলের অর্ধ শতাধিক কমিউনিটি ক্লিনিক (সিসি) ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগই সকাল ৯টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত তালাবদ্ধ থাকে। কোথাও কোথাও ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা বা ১টা পর্যন্ত খোলা। এরপর আবার তালাবদ্ধ। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত সার্ভিস প্রোভাইডর, পরিবার পরিকল্পনা সহকারী ও অফিস সহকারীসহ তিন থেকে চারজন কর্মরত থাকার কথা থাকলেও উপস্থিত পাওয়া গেছে মাত্র একজন করে। অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরতদের বেশিরভাগই জানান, ‘বাইরে আছে অথবা ট্রেনিংয়ে অথবা উপজেলা অফিসে অথবা মাত্র রোগী শেষ করে বেরিয়েছে’। সরেজমিনে জেলার তারাকান্দা উপজেলার রামচন্দ্রপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সামনে অবস্থান করে দেখা গেছে, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ক্লিনিকটি তালাবদ্ধ। চিকিৎসক না পেয়ে ১৫ থেকে ২০ জন রোগী নিরাশ ফিরে গেছেন। একই দিন বেলা ১টায় এবং ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত মুক্তাগাছা উপজেলার কুমারগাতা ইউনিয়নের গাড়াইকুটি কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, তালাবন্ধ ক্লিনিকের সামনে ১০ থেকে ১৫ জন নারী ও শিশু চিকিৎসকের অপেক্ষায় দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে। এ সময় স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন অনিয়তিভাবে ডাক্তার থাকেন। আর জ্বর বা কাশির বড়ি ছাড়া কোনো বড়ি দেয় না। সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত ছুটে আসেন সার্ভিস প্রোভাইডার সাবিনা ইয়াসমিন ও সভাপতি শফিকুল ইসলাম। এ সময় দুজনই রোগী ও স্বজনদের তোপের মুখে পড়েন ক্লিনিক না খোলায়। এরপর পার্শ্ববর্তী পাথালিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকও বন্ধ ছিল। মনতলা কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায় একজন উপস্থিত। এদিকে বেলা ১২টা পর্যন্ত তালাবন্ধ ছিল সদর উপজেলার ঘাঘড়া ইউনিয়নের বাড়েরার পাড় কমিউনিটি ক্লিনিক, মধ্য বাড়েরায় পাওয়া যায়নি প্রোভাইডারকে।বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিকের সামনে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষমাণ বিশেষ করে সদর উপজেলার বাড়েরার পাড়ের হালিমা খাতুন ও লতিফ মুন্সী, মুক্তাগাছা উপজেলার কুমারগাতা ইউনিয়নের গড়াইকুটি গ্রামের মফিদুল ও সোহাগ, হালুয়াঘাট উপজেলার আমতৈল ইউনিয়নের বাহির শিমুল গ্রামের তৈয়ব আলী ও খোদেজা বেগম, তারাকান্দা উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের ফরিদা ইয়াসমিন ও আসমা আক্তার আক্ষেপ আর অভিযোগ করে বলেন, দূর-দূরান্ত থেকে অতি কষ্টে হেঁটে অথবা রিকশায় করে ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসার জন্য এসে বেশির ভাগ সময় তালাবন্ধ পায়। আর বড় ডাক্তার (প্রোভাইডার) না থাকলে অন্যরা সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে দু’একটি ওষুধ দিয়ে বিদায় করে দেয়। তাদের অভিযোগ, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন স্বাস্থ্যকর্মীরা অনিয়মিত এলেও হাজিরা দিয়ে আবার চলে যান ঘণ্টাখানেক বসে। ৫ টাকার টিকিট করেও ঠিকমতো ওষুধ পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও সেটা ৫০ পয়সা অথবা এক টাকা দামের প্যারাসিটামল, হিস্টাসিন, গ্যাস্ট্রিক অথবা কোনো ভিটামিন। তাদের অভিযোগ, বরাদ্দকৃত মূল্যবান ওষুধপত্র কমিটির লোকজনকে ম্যানেজ করতে শেষ হয়ে যায়। এসএস/আরআইপি
Advertisement