প্রথমত বৈশ্বিক মহামারির উৎসস্থল, এরপর টানা ৭৬ দিনের কড়া লকডাউনে রীতিমতো দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল উহানবাসীর জীবন। চীনে করোনাভাইরাসে প্রাণহানির পাঁচ ভাগের চার ভাগই ঘটেছে এই একটি শহরে। তবে সেই বিষাদের আঁধার মিলিয়ে উহানে দেখা দিয়েছে ভরসার নতুন সূর্য। স্থানীয়রা তো বটেই, এখন বাইরের পর্যটকদের কাছেও অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে শহরটি।
Advertisement
গত মে মাসের পর উহানে আর কোনও নতুন করোনা রোগী পাওয়া যায়নি। ওই মাসে ছোট আকারে একবার সংক্রমণ শুরু হলে সঙ্গে সঙ্গেই গণহারে নমুনা পরীক্ষা শুরু করে চীনা কর্তৃপক্ষ। অল্প কিছু লোকের কারণে শহরের পুরো ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল মাত্র দুই সপ্তাহে। কঠোর সেই পদক্ষেপে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে উহানবাসীর মনে। তারা এখন দলে দলে শপিংয়ে যাচ্ছেন, ক্যারাওকে পার্টি করছেন। মাস্ক খুলে যেন প্রাণভরে দম নিচ্ছেন উহানের মানুষেরা, সাঁতার কাটতে যাচ্ছেন ইয়াংজি নদীতে। পর্যটকেরা ভিড় জমাচ্ছেন শহরটির বিখ্যাত ইয়েলো ক্রেন টাওয়ারে।
ঝ্যাং হানিয়ে নামে উহানের এক পর্যটনকর্মী বলেন, ‘তারা মনে করে উহান নায়কদের শহর, আর সবাই আমাদের দেখতে আসতে চায়।’
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, এপ্রিলের শেষের দিকে লকডাউন তুলে দেয়ার পর থেকে চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে উহান। ভাইরাস ছড়ানোর আগে আট নম্বরে থাকলেও এরপর একলাফে তারা উঠে এসেছে তালিকার শীর্ষস্থানে।
Advertisement
এগুলোকেই সাফল্যের প্রোপাগান্ডা হিসেবে প্রচার করছে চীনা সরকার। মহামারি শুরুর দিকে ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে উহানের চিকিৎসকদের মুখ বন্ধ করিয়ে দেয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছিল তারা। আগাম ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার অভিযোগও ছিল সরকারের দিকে। কিন্তু গত মাসে উহানের একটি ওয়াটার পার্কের মিউজিক ফেস্টিভালে হাজারও মানুষের আনন্দ-উদযাপনের ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস লিখেছে, ‘উহানের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে এখনও খুব বেশি দেরি হয়নি’।
চলতি মাসেই চাইনিজ পিপলস অ্যাসোসিয়েশন ফর ফ্রেন্ডশিপ উইথ ফরেইন কান্ট্রিস নামে একটি সরকার সমর্থিত সংস্থা ২০টি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে তিন দিনের সফরে উহান গিয়েছিল। সংস্থাটির সভাপতির মতে, উহানের পুনরুত্থান স্বচক্ষে দেখাই ছিল এ সফরের মূল উদ্দেশ্য। সফরকালে অতিথিদের নিয়ে একটি অস্থায়ী হাসপাতালে যাওয়া হয়, যেটি এখন পুরো খালি পড়ে আছে। একটি সুপারমার্কেট ও একটি অভিজাত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থাও দেখেছেন তারা। ভ্রমণকালে অতিথিদের সবাই চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির নেয়া পদক্ষেপগুলোর প্রশংসাবাক্যই শুনিয়েছেন।
শুধু পর্যটকেরাই নয়, সরকারের ওপর খুশি উহানের জনসাধারণও। লকডাউনের সময় খাবার, ওষুধ ও চিকিৎসকদের পরিবহনের দায়িত্ব থাকা ৫০ বছর বয়সী এক গাড়িচালকের মতে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সিদ্ধান্তগুলো ছিল ‘অসাধারণ’।
লকডাউনের সময় উহানে থেকে যাওয়া এক ফরাসি চিকিৎসক ফিলিপ্পে ক্লেইন বলেন, ‘এখন উহানই হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। শহরের অনেক মানুষই ভুলে যেতে চান যে, আমরা এক বিপর্যয়ের উৎস ছিলাম।’ অনেকটা একই কথা বলেছেন আরেক যুবক। তার ভাষ্য, ‘অপ্রিয় বিষয় মনে রাখতে হবে কেন?’
Advertisement
উহানবাসীর মনে এখন সুখ যেমন আছে, তেমনই সেখানে ভয় ও ভোগান্তির চিহ্নও আছে যথেষ্ট। বেশিরভাগ লোকই বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে তাদের নাম বলতে চান না। ‘বিক্রি হবে’ লেখা অন্ধকার দোকানগুলোকে উপেক্ষা করা কঠিন। শহরটিতে দৈনিক মেট্রো চলাচল করছে গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় মাত্র তিন-চতুর্থাংশ। প্রকাশ্যে অনেকেই বলছেন, উহান এখন দৌড়াবে। তবে গোপনে হয়তো অনেকেই অনলাইন লেখক ফ্যাং ফ্যাং-এর সতর্কবার্তাগুলো মনে করছেন, ‘কাঁদার জন্য এখনও আমাদের অনেক অশ্রু বাকি।’
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
কেএএ/এমএস