ইয়াবার চেয়ে শক্তিশালী মাদক অ্যামফিটামিন। বাংলাদেশে তৈরি না হলেও বাইরে থেকেই আসা এই মাদক পাচারে রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ঢাকা। গত ৯ সেপ্টেম্বর ২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা মূল্যের মাদক অ্যামফিটামিন পাচারের চেষ্টায় ব্যবহার করা হয়েছে আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস। এক্ষেত্রে দেয়া হয়েছে মিথ্যা তথ্য। আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ঠিকানায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে কারও সন্ধান পায়নি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। যে কারণে ওই চালানের সঙ্গে জড়িত কাউকে এখনো আটক করা যায়নি।
Advertisement
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশে পাঠানোর প্রাক্কালে অ্যামফিটামিনের ওই চালানই দেশে বড় মাদকের চালান জব্দের ঘটনা। দেশে ও দেশের বাইরে মাদকের চোরাচালানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিসকে। মাদকের চোরাচালান বন্ধে কুরিয়ার সার্ভিসে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি সুরক্ষা নীতি গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কুরিয়ার সার্ভিসে মাদকের হোম ডেলিভারির খবর গণমাধ্যমে এসেছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো অভিযানও চালিয়েছে। কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিসকে সুরক্ষামূলক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি শক্তিশালী নজরদারি প্রয়োজন। দরকার জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। দরকার যুগোপযোগী আইন ও নীতিমালা।
র্যাব, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের মতো বৈশ্বিক দুর্যোগেও থেমে নেই মাদককারবারি চক্রের কারবার। তল্লাশি ও নজরদারিতেও বিভিন্ন কৌশলে দেশে মাদকের চালান আনছে তারা। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফ থেকে ইয়াবা, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর মতো সীমান্ত থেকে আসছে ফেনসিডিল। ত্রাণ বিতরণ, ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্যের আড়ালেও কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠানো পার্সেলকে ব্যবহার করা হচ্ছে মাদকের চোরাকারবারে।
Advertisement
গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর দারুসসালাম থানাধীন কল্যাণপুরের সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে অস্ত্র এবং বিপুল পরিমাণ মাদক ও গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় আটক করা হয় নারায়ণগঞ্জের গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুল জলিল মাতবরকে। পার্সেল থেকে একটি দেশি পিস্তল, ৪০ রাউন্ড পিস্তল ও রাইফেলের গুলি, ৫ হাজার ২৮৯ পিস ইয়াবা, ১ কেজি ৩০০ গ্রাম গাঁজা, ৯ ক্যান বিয়ার ও ৪০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়।
গত ১৫ জুন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় আনা হয় আমভর্তি কার্টন। আমের আড়ালে হেরোইনের বড় চালান আসার খবর পেয়ে এলিফ্যান্ট রোডে তল্লাশি চৌকি বসায় র্যাব-২। সেখানে আটক করা হয় হাবিবুর রহমান (২৯) ও দিলরুবা দিপা (২৯) দম্পতিকে। উদ্ধার করা হয় আধা কেজি হেরোইন।
গত ৩১ আগস্ট সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আসবাবপত্রের আড়ালে কুমিল্লা থেকে ৫১ কেজি ৯০০ গ্রাম গাঁজা রাজশাহী পৌঁছলে র্যাবের হাতে সেগুলো জব্দ হয়। অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় ছয়জনকে।
তার আগে গত বছরের ৯ এপ্রিল কক্সবাজার থেকে ইয়াবার বড় একটি চালান রাজশাহী আসে এসএ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। জয়পুরহাটের দুই ভাই সেই ইয়াবা কুরিয়ার সার্ভিস থেকে তুলে নেয়ার সময় নগরীর ভদ্রা বাসস্ট্যান্ড থেকে তাদের আটক করে র্যাব।
Advertisement
সেই বছরের ১৯ মে রাজধানীর উত্তরায় এসএ পরিবহনের অফিস থেকে এক লাখ পিস ইয়াবা জব্দসহ দুই মাদক কারবারিকে হাতেনাতে আটক করে র্যাব।
একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর কাকরাইল থেকে ৯২০০ পিস ইয়াবাসহ আন্তঃজেলা মাদক ব্যবসায়ী চক্রের দুই সদস্যকে আটক করে র্যাব।
এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ঢাকা মেট্রো-উত্তর) উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদকের চোরাকারবার হচ্ছে। শুধু এ বছরই কুরিয়ারের মাধ্যমে মাদকের চোরাচালানের অভিযোগে ১২টি অভিযান পরিচালনা করেছি, জব্দ করেছি বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য। কুরিয়ার সার্ভিসে যেন মাদকজাতীয় কোনো কিছু চোরাচালান না হয় সেজন্য নিয়ন্ত্রণ এবং কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতার প্রয়োজন তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে গত ৯ সেপ্টেম্বর অ্যামফিটামিনের চালান জব্দের পর কুরিয়ারকেন্দ্রিক নজরদারি বাড়িয়েছি আমরা। একাধিক টিম কাজ করছে। গোয়েন্দারা হোতাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, কুরিয়ারে পার্সেল ডেলিভারির ক্ষেত্রে যেন প্রেরক ও প্রাপকের সঠিক ঠিকানা, এনআইডির কপি সংগ্রহ, সক্রিয় সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং স্ক্যানিংয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়ে আমরা চিঠি দিচ্ছি।
এ ব্যাপারে মাদক বিশেষজ্ঞ সাবেক সচিব ভূঁইয়া শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সবকিছুর আগে দরকার মোরালিটি। কিন্তু দেশে তো গণতন্ত্র বলেন, আর রাজনীতি বলেন, কোনো কিছুতেই তো এর উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, এই দেশে ইয়াবা বা অ্যামফিটামিন যে তৈরি হয় না, এ ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। কারণ এর আগে কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীই কারখানা আবিষ্কার করেছে। একজন সরকারদলীয় মন্ত্রীর ছেলের দ্বারা চালিত মাদক কারখানা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কারও নাম-পরিচয়, মুখের দিকে তাকানোর সুযোগ নেই। মুখের কথায় নয়, মাদক নির্মূলে আইনের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। দুঃখজনক যে, সেটা এখনো পরিলক্ষিত হয়নি।
তিনি বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যক্রম মনিটর করতে হবে। কিন্তু মনিটর কে করবে? এক কেজি দেড় কেজির একটা প্যাকেটে লাখ পিস ইয়াবা থাকতে পারে। সেটা মনিটর করার মতো ব্যবস্থাপনা সরকারকেই করতে হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন) ডিআইজি মাসুম রব্বানী জাগো নিউজকে বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসকে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের কাজ নয়। কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিসে মাদকের চোরাচালান ঠেকাতে যা যা করা দরকার সেটা আমরা করবো। আমরা চাই তারা আরও স্বচ্ছতা নিয়ে আসুক। মাদকের মতো অপরাধে তারা সহযোগী না হয়ে এমন অপরাধীদের ধরার ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগী হোক। এজন্য ব্যবস্থা নিতে আমরা মন্ত্রণালয়কে কিছু লিখিতভাবে অনুরোধ করবো।
কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (সিএসএবি) সভাপতি হাফিজুর রহমান পুলক জাগো নিউজকে বলেন, কুরিয়ার সার্ভিস কখনো মাদকের চোরাচালানে সহযোগিতা করে না। আমরা সরকারের কাছে স্ক্যানার চেয়েছি। ভর্তুকিও দিচ্ছি। প্রয়োজনে পার্সেল স্ক্যানপ্রতি ১০-২০ পয়সাও দিতে চেয়েছি। তবু স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন না উঠুক কুরিয়ার সেক্টরে। কিন্তু সরকার তো সে ধরনের কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি।
তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে প্রেরক ও প্রাপকের জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) কপি রাখা, সক্রিয় মোবাইল নম্বর সরাসরি চেক করা, সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের জন্য সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকটি কুরিয়ার হাউজকে নির্দেশনা দিয়েছি। সামনে কমিটির মিটিং হবে। সেখানে এসব নিয়ে ফের আলাপ হবে। প্রত্যেকটি বড় কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানে মাদক চেক করার স্ক্যানার মেশিন স্থাপনে জোর দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে সুন্দরবন কুরিয়ারে ১০ কেজি ওজনের পার্সেল চেক করার জন্য স্ক্যানিং ক্রয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ইন্টারন্যাশাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএইএবি) সভাপতি কবির আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা ব্যবসায়ী ও নাগরিক হিসেবে চাই যেন কুরিয়ারে কোনো চোরাচালান না হয়। আমরা সিভিল এভিয়েশন কিংবা ঢাকা কাস্টমসসহ সবার সাথে মিলে যে পলিসি, সেফটি, সিকিউরিটি, ইফিসিয়েনসি সব মেইনটেইন করি। ব্যবসার ক্ষেত্রে সবাই কুরিয়ারকে ব্যবহার করে। কোনো বাহিনী চোরাচালান সংক্রান্ত তথ্য বা সহযোগিতা চাইলে আমরা করি। চোরাচালান টের পেলে আমরা সেই পার্সেল রিসিভ করি না, বাতিল করি।
তিনি বলেন, আরও স্বচ্ছতার সাথে কীভাবে আমাদের শিফমেন্টগুলো করতে পারি সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। তবে নারকটিকস কিংবা অন্য কোনো সংস্থা যেন তদন্ত ছাড়াই হুটহাট কুরিয়ার সার্ভিসের কাউকে আটক না করে সেজন্য আমরা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেব।
এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জাগো নিউজকে বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসকে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের কাজ নয়। আমরা লাইসেন্স দেই। গুরুতর অভিযোগ উঠলে তা বাতিল করি। এই সেক্টরে অনেক মানুষ কাজ করছে। এখানে নিয়ন্ত্রণ নয়। তবে চোরাচালানের ক্ষেত্রে কুরিয়ার সার্ভিসকে যেন ব্যবহার করার সুযোগ না থাকে সেজন্য যে নীতিমালা রয়েছে, সেটা যুযোপযোগী করা হবে।
জেইউ/এইচএ/বিএ/এমকেএইচ