বিশেষ প্রতিবেদন

শর্ত লঙ্ঘন করেই প্রশাসনে চলছে পদোন্নতি!

পদোন্নতির ক্ষেত্রে পদ শূন্য থাকা শর্ত থাকলেও প্রশাসনে ক্রমাগত এই শর্ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। পদ না থাকার পরও পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। তাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে প্রশাসনে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।

Advertisement

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গত বুধবারের (১৬ সেপ্টেম্বর) তথ্য অনুযায়ী, প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের ১৩০টি স্থায়ী পদের বিপরীতে কর্মকর্তা রয়েছেন ৪৭৪ জন এবং ৪৫০টি যুগ্ম-সচিব পদের বিপরীতে কর্মকর্তা ৮৪৯ জন। এছাড়া উপ-সচিবের এক হাজার ছয়টি পদের বিপরীতে কর্মকর্তা রয়েছেন এক হাজার ৬৩৪ জন।

এই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রশাসনের শীর্ষভাগে স্থায়ী পদের বিপরীতে প্রায় দ্বিগুণের বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের নিচের পদে কাজ করতে হচ্ছে, কাউকে থাকতে হচ্ছে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে।

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির স্থবিরতায়ও পদোন্নতি থেমে থাকেনি। গত ৫ জুন করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যে ১২৩ জন উপ-সচিবকে যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।

Advertisement

গত ১ সেপ্টেম্বর বিলুপ্ত অর্থনৈতিক ক্যাডার থেকে প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত হওয়া ২২০ জন কর্মকর্তাকে উপ-সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরের দিন ২ সেপ্টেম্বর অর্থনৈতিক ক্যাডারের ১৪৩ কর্মকর্তাকে যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।

৩ সেপ্টেম্বর অর্থনৈতিক ক্যাডারের ২৫ জনকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।

২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের অর্থনৈতিক ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত করা হয়। অর্থনৈতিক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উপ-সচিব পদে পদোন্নতির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে ছিল।

জানা গেছে, উপ-সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। উপ-সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ২৭তম ব্যাচকে, অপরদিকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার জন্য ১৩তম ব্যাচকে মূল ব্যাচ হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হবে।

Advertisement

সংশ্লিষ্ট অনেকের প্রশ্ন, ক্রমাগত এমন পদোন্নতির মাধ্যমে আসলে কোথায় যাচ্ছে প্রশাসন? সরকারের উচিত বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রশাসন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, ‘পৃথিবীর প্রশাসনের ইতিহাসে এমন জিনিস (পদ ছাড়া পদোন্নতি) দেখা যায় না। এটা শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। এটা আমরা বাংলাদেশে প্রথম দেখছি, এই আওয়ামী লীগের আমলে। পোস্ট ছাড়া পদোন্নতি দেয়। পদোন্নতি দেয়ার প্রথম শর্তই হলো পদ খালি থাকা এবং পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা। এভাবে ক্রমাগত পদোন্নতির ভবিষ্যৎ ফল খুব খারাপ হবে। নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেবে।’

এক্ষেত্রে সরকারের করণীয় বিষয়ে সাবেক মহা-হিসাবরক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘যে স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস সেটাই সরকারকে করতে হবে। স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস হলো পদের বিপরীতে পদোন্নতি দেয়া। পদ না থাকলে পদ সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশের প্রশাসন তো আজকের না, আমরাও তো চাকরি করেছি। এমন পরিস্থিতি তো কখনও হয়নি।’

অধিশাখা বলতে উপ-সচিব বা তার সমপদমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তার আওতাধীন কতিপয় শাখার সমষ্টিকে বোঝায়। কিন্তু বলতে গেলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধিশাখাগুলো অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম-সচিবদের দখলে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা অধিশাখায় দায়িত্ব পালন করছেন একজন অতিরিক্ত সচিব। উপকরণ, বাজেট ও মনিটরিং, আইসি, পিপিবি অধিশাখায়ও যুগ্ম-সচিব রয়েছেন।

স্থানীয় সরকার বিভাগের উপজেলা ও অডিট অধিশাখায়ও রয়েছেন একজন অতিরিক্ত সচিব। এই বিভাগের পরিকল্পনা, আইন, ইউনিয়ন পরিষদ, পানি সরবরাহ, উন্নয়ন, নগর উন্নয়ন-১, নগর উন্নয়ন-২, মনিটরিং ও মূল্যায়ন, প্রশাসন, পলিসি সাপোর্ট অধিশাখার দায়িত্বে রয়েছেন যুগ্ম-সচিবরা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কমিটি ও অর্থনৈতিক অধিশাখা সামলাচ্ছেন একজন অতিক্তি সচিব।

অনুবিভাগ বলতে স্বতন্ত্র প্রকৃতির নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য গঠিত কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের স্বয়ংসম্পূর্ণ অনুবিভাগকে বোঝাবে, যার প্রধান একজন যুগ্ম-সচিব বা অতিরিক্ত সচিব হবেন। তবে বলতে গেলে সব অনুবিভাগেই বসে আছেন অতিরিক্ত সচিবরা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আটটি অনুবিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন আটজন অতিরিক্ত সচিব। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ছয়টি অনুবিভাগেও রয়েছেন ছয়জন অতিরিক্ত সচিব। অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতেও একই অবস্থা।

শাখা বলতে মন্ত্রণালয়/বিভাগের মূল কার্য সম্পাদনকারী ইউনিটকে বোঝায়। যার প্রধান একজন সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিব বা সমপদমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তা হবেন। তবে শাখাগুলো রয়েছে উপ-সচিবদের দখলে। কোথাও কোথাও যুগ্ম-সচিবও শাখা সামলাচ্ছেন।

প্রশাসন ছাড়াও মোট ক্যাডারের সংখ্যা ২৬টি। তবে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অন্য ক্যাডারের ক্ষেত্রে চিত্র ভিন্ন। পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জনের পরও বছরের পর বছর একই পদে কাজ করতে হচ্ছে। একই ব্যাচের হয়েও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব হয়ে গেছেন, কিন্তু অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তা রয়ে গেছেন সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায়। অন্য ক্যাডারের শীর্ষপর্যায়ের পদসংখ্যা কম এবং খালি না থাকায় মূলত তাদের পদোন্নতি দেয়া হয় না।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘পদোন্নতি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। যারা পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেন, তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়। এটা না হলে তারা উদ্যম হারিয়ে ফেলবেন।’

কী আছে পদোন্নতি নীতিমালায়

উপ-সচিব থেকে ওপরের পদগুলো কোনো নির্দিষ্ট ক্যাডারের নয়, সরকারের পদ হিসেবে পরিচিত। ‘সরকারের উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা, ২০০২’ অনুযায়ী এসব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।

বিধিমালা অনুযায়ী, উপ-সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এবং ২৫ শতাংশ অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিবেচনায় নিতে হবে।

উপ-সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সিনিয়র সহকারী সচিব পদে পাঁচ বছর চাকরিসহ সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের সদস্য হিসেবে কমপক্ষে ১০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। মূল্যায়ন নম্বরের অন্তত ৮৩ নম্বর পেতে হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

বিধিমালয় আরও বলা হয়েছে, যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এবং ৩০ শতাংশ অন্যান্য ক্যাডারের উপ-সচিব পদে কর্মরতদের বিবেচনায় নিতে হবে।

বিধিমালা অনুযায়ী, উপ-সচিব পদে কমপক্ষে পাঁচ বছর চাকরিসহ সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের সদস্য হিসেবে কমপক্ষে ১৫ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা বা উপ-সচিব পদে কমপক্ষে তিন বছর চাকরিসহ ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে কোনো কর্মকর্তা যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হবেন। এক্ষেত্রে মূল্যায়ন নম্বরের অন্তত ৮৫ পেতে হবে।

অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এবং ৩০ শতাংশ অন্যান্য ক্যাডারের যুগ্ম-সচিব পদে কর্মরতদের বিবেচনায় নিতে হবে। এক্ষেত্রেও মূল্যায়ন নম্বরের অন্তত ৮৫ নম্বর পেতে হবে।

যুগ্ম-সচিব পদে কমপক্ষে তিন বছর চাকরিসহ ২০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা বা যুগ্ম-সচিব পদে কমপক্ষে দুই বছরের চাকরিসহ ২২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির জন্য বিবেচনায় নেয়া হয়।

সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সচিব পদে কমপক্ষে দুই বছর চাকরিসহ অন্তত ২২ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। তবে অতিরিক্ত সচিব পদে কমপক্ষে এক বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো কর্মকর্তার ওই পদে দুই বছর পূর্তির আগে তার চাকরির বয়স পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তার ক্ষেত্রে দুই বছরের চাকরির অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সচিবালয়ের কোনো পদে পাঁচ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম-সচিব পদে কমপক্ষে দুই বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকলে তার ক্ষেত্রে এই শর্ত শিথিল হবে। পেতে হবে মূল্যায়ন নম্বরের কমপক্ষে ৮৫।

আরএমএম/এইচএ/এমএআর/এমএস