বিশেষ প্রতিবেদন

‘হতদরিদ্রের আচরণ পরিবর্তনে’ ৪০ কোটি খরচের প্রস্তাব

>> মূল প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ১৮৮৩ কোটি টাকা>> পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পেছনে ব্যয় ২৬ কোটি >> ২৮ কোটি টাকা খরচ হবে হাত ধোয়ার পেছনে >> বিদেশ সফরের জন্য থাকছে পাঁচ কোটি টাকা

Advertisement

হতদরিদ্র বা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের আচরণ পরিবর্তনের জন্য ৩৯ কোটি ৬৪ লাখ ৬৮ হাজার টাকা খরচের প্রস্তাব দিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। হতদরিদ্ররা কীভাবে হাত ধোবে, নিরাপদ পানির ব্যবহার করবে, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারবে এবং করোনার বিস্তার রোধ করবে— এমন বিষয়গুলো শেখানোর জন্য ওই টাকা খরচের প্রস্তাব দিয়েছে তারা।

‘মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি’ শীর্ষক এক প্রকল্পের আওতায় এ কার্যক্রম চলবে। প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে বাস্তবায়ন করবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমানের কার্যালয়ে যায় জাগো নিউজ। প্রধান প্রকৌশলী বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিকল্পনা সার্কেল) মোহাম্মদ আনোয়ার ইউসুফের কাছে যেতে বলেন।

Advertisement

আনোয়ার ইউসুফের কাছে প্রকল্পটির বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘যাতে তারা (হতদরিদ্র বা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ) নিরাপদ পানি ব্যবহার করতে পারে, সেফলি স্যানিটেশনটা (নিরাপদ প্রস্রাব-পায়খানা) তারা ম্যানেজ করতে পারে, তারা স্বাস্থ্যবিধি করোনাভাইরাসসহ সম্পর্কে যেন আরও সচেতন হয়। আগে তারা যে জিনিসটা জানত না বা অভ্যস্ত ছিল না, সেই জিনিসটাতে যেন তারা অভ্যস্ত হয়; এসব বিষয় নিয়ে ক্যাম্পেইন করা হবে।’

আচরণ পরিবর্তনে হতদরিদ্রদের মাঝে কীভাবে প্রচারণা চালানো হবে, সেটার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘দুই উপায়ে এর প্রচার চালানো হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক, পরিবার পরিকল্পনায় কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের এ বিষয়ে আরও প্রশিক্ষণ দেয়া। ফলে কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীদের কাছে যখন মানুষ চিকিৎসা নিতে আসবে, তখন তারা সচেতনতার এই বার্তা পৌঁছে দেবে। আর পরিবার পরিকল্পনায় কর্মরতরা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সভা করেন। মাসে তারা মায়েদের নিয়ে সভা করেন। স্কুলের কিশোরীদের নিয়ে সভা করেন। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা যখন সভাগুলো করবেন, তখন এই জ্ঞান তারা ওইখানে ছড়িয়ে দিতে পারবেন। এভাবে তারা তৃণমূল পর্যায়ে বার্তাটা পৌঁছে দিতে পারবেন।’

দ্বিতীয় উপায় তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ওয়ার্ডে বছরে দুবার করে ভিজুয়াল সভা করা হবে। মেয়ে-মায়েদের জন্য সভা করা হবে। যারা সাধারণত বেশি বাইরে আসেন না, তাদের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীদের দিয়ে এটা করা হবে। আর পুরুষদের জন্য ভিজুয়াল মিটিং করা হবে বছরে দুবার। আমরা অনুমান করেছি, প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রতিবার যদি কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ জন থাকে বা ১০০ জন থাকে— এভাবে হিসাব করে একটা এস্টিমেট স্ট্রাকচার দাঁড় করানো হয়েছে। তিন বছর ধরে চলতে থাকবে এই কার্যক্রম। এভাবে হিসাব করে দরিদ্রদের আচরণ পরিবর্তনের জন্য ৪০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।’

পাশাপাশি বুকলেট নির্দেশিকাও দেয়া হবে এবং ইউনিয়ন পরিষদের স্টেকহোল্ডার, স্কুলের শিক্ষকদেরও এতে যুক্ত করা হবে বলে জানান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী।

Advertisement

করোনাকে সামনে রেখে এ ধরনের সচেতনতামূলক প্রচার অত্যন্ত জোরালোভাবে সরকারি গণমাধ্যম, বেসরকারি গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করা হচ্ছে। তারপরও এ প্রকল্প নিতে যাচ্ছেন? তাছাড়া যে ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে, তাতে প্রায় ৪০ কোটি খরচ হওয়া কতটা যৌক্তিক— এমন প্রশ্নে আনোয়ার ইউসুফ বলেন, ‘এটা হলো নীতিনির্ধারকদের ব্যাপার। আমাদের দায়িত্ব হলো প্রস্তাবনা সরকারের কাছে দেয়া। সরকার যদি মনে করে, এই প্রচারের দরকার নেই, তাহলে বাদ হয়ে যেত। কিন্তু সরকার এটা মনে করছে না। আমাদের মন্ত্রণালয়ের সভা হয়েছে, পরিকল্পনা কমিশনে সভা হয়েছে; কখনও কিন্তু তারা বলেননি যে, এই প্রচারের দরকার নেই। তারা যেটা বলছে, দেখ এটাকে আরও কতটুকু সুইচ (কমিয়ে) করে নিয়ে আসা যায়। আমরা সেটার চেষ্টা করছি। আগে যদি আমরা ১০টা মিটিং ধরি, তাহলে এখন আমরা কমিয়ে নিয়ে আসব। বছরে দুটা না করে, একটা করব। লিফলেট, পোস্টার আমরা কমিয়ে দেব। পিইসি সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, আবার এটাকে রিভিজিট (সংশোধন) করে খরচ যৌক্তিকভাবে কতটুকু কমানো যায়, সেই হিসাবে কাজ করছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি’ শীর্ষক প্রকল্পটির মোট খরচ ধরা হয়েছে এক হাজার ৮৮৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। তার মধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের অঙ্গভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) ও এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) ঋণ হিসাবে দিচ্ছে এক হাজার ৮৩২ কোটি ২৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।

প্রকল্পটিতে নানা অসঙ্গতি থাকায় তা সংশোধন করে পুনরায় পাঠাতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

পরামর্শক খরচ ২৬ কোটি

হতদরিদ্রের আচরণ পরিবর্তন, গ্রামাঞ্চলে পানির লাইন যাওয়াসহ এ প্রকল্প বাস্তবায়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পেছনে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬ কোটি ৯৭ লাখ ১২ হাজার টাকা।

এই প্রকল্পের জন্য পরামর্শক ব্যয় এত ধরার কারণ কী? জানতে চাইলে আনোয়ার ইউসুফ বলেন, ‘এখানে কমিউনিটি পর্যায়ে পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম করা হবে দুই হাজার ৯৬৪টি এবং লার্জ পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম করা হবে ৭৮টি। প্রতিটার জন্য ডিজাইন ও সুপারভিশন এবং কাজটা যেন সুষ্ঠুভাবে হয়, এজন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ধরা হয়েছে। পরিবেশের যেন ক্ষতি না হয়, সেজন্য আমাদের পরামর্শক রাখতে হয়। বিধি-বিধান মেনেই তাদের বেতন হবে। পরামর্শকদের মাসিক বেতন তিন লাখ টাকার ওপরে নেই।’

হাত ধোয়ার খরচ সাড়ে ২৮ কোটি টাকা

প্রকল্পের আওতায় করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন স্কুল ও পাবলিক স্পটে হাত ধোয়ার স্টেশন স্থাপন করা হবে। এতে মোট খরচ হবে ২৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। হাত ধোয়া স্টেশন করা হবে মোট এক হাজার ৪২৫টি। প্রতিটি হাত ধোয়ার জায়গা করতে খরচ হবে দুই লাখ টাকা করে।

দুই লাখ টাকা খরচে হাত ধোয়ার স্টেশনে কী থাকছে, জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিকল্পনা সার্কেল) মোহাম্মদ আনোয়ার ইউসুফ বলেন, ‘দুই লাখ টাকায় খালি বেসিন বসানো হবে না। ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) বলা হয়েছে, হ্যান্ডওয়াশিং স্টেশন উইথ রানিং ওয়াটার সাপ্লাই নির্মাণ করা হবে। এটার জন্য প্রতিটি স্টেশনে গড় ২৭৫ মিটার গভীরতার গভীর নলকূপ স্থাপন করা হবে সাবমার্সিবল পাম্পসহ। গভীর নলকূপের গভীরতা হয়তো কোথাও কম হবে, কোথাও বেশি হবে, গড় ২৭৫ মিটার গভীরতা ধরে নিয়েছি আমরা। যেন এর পানি খাওয়ার উপযোগীও হয়। বিদ্যুতের ব্যবস্থাও থাকবে। একটা ওভারহেড স্ট্রাকচার থাকছে, যাতে হাত ধোয়ার জন্য একটা ট্যাংক থাকবে এক হাজার লিটারের। বেসিন যেটা হবে, সেটা পাঁচটা ট্যাবের। টাইলসের ব্যবস্থাও থাকবে। বিভিন্ন রেল স্টেশনে যেমন থাকে আর কি। এগুলো স্কুল, বাজার বা জনবহুল স্থানে স্থাপন করা হবে। তবে এগুলো কোথায় বসবে, তা ঠিক করবে স্থানীয় প্রশাসন।’

তিনি বলেন, ‘এই রেট কমানো যেতে পারে। যদি পাঁচটা ট্যাবসহ ২৭৫ মিটার গভীর থেকে নিরাপদ পানি ওঠাতে হয়, এসব ব্যবস্থাপনার জন্য এই টাকা আমাদের কাছে যৌক্তিক। যেটা আমরা দিয়েছি, সেটা আমাদের প্রস্তাবনা। সরকার যদি মনে করে, পাঁচটা ট্যাবের দরকার নেই, তিনটা করো বা স্ট্রাকচারের দরকার নেই, তখন খরচ কমে যাবে।’

‘হাত ধোয়ার স্টেশন স্থাপনের অংশটি করোনার কারণে প্রকল্পে যুক্ত করা হয়েছে’ জানিয়ে আনোয়ার ইউসুফ আরও বলেন, ‘প্রকল্পটা তৈরির কাজ চলছে প্রায় দুই বছর হলো। করোনার প্রকোপ দেখা দিলে হ্যান্ডওয়াশিং স্টেশনটা যুক্ত করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এটা ছিল না। এটা প্রকল্পটিতে খুবই ক্ষুদ্র উপাদান। মূল বিষয়টা হলো, গ্রামে পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা। এখানে কমিউনিটি পর্যায়ে পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম করা হবে দুই হাজার ৯৬৪টি এবং লার্জ পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম করা হবে ৭৮টি। হতদরিদ্রদের জন্য টয়লেট দেয়া হবে তিন লাখ নয় হাজার ৩৬টি। এগুলো মূল কার্যক্রম এটার।’

বিধান থাকলেও প্রকল্পটির ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়নি। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারের রুলস তো আমরা ব্রেক করতে চাচ্ছি না। আমরা তো হতদরিদ্রদের জন্য জিনিসটা দিচ্ছি। হতদরিদ্রদের ওপর সরকারের একটা তালিকা আছে। কোন জেলায় কত শতাংশ দরিদ্র। ফিজিবিলিটি স্টাডি বলতে কী…, ডিপার্টমেন্ট অনুযায়ী তো আমরা জানি যে, কোনখানে পানি সাপ্লাই কাভারেজ কত। কোনখানে আর্সেনিক আছে, কোনখানে নেই। কোন গভীরতায় আয়রন আছে বা কোনখানে দরকার। এগুলোর তো আমাদের অভ্যন্তরীণ হিসাব আছেই।’

বিদেশ সফরে খরচ পাঁচ কোটি টাকা

প্রকল্প সূত্র জানায়, এসব কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনে বিদেশেও যাবেন কর্মকর্তারা। তাতে খরচ ধরা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা।

অতি দরিদ্রদের জন্য এ প্রকল্পের আওতায় তিন লাখ নয় হাজার ৩৬টি টয়লেট প্রদান করা হবে। এর জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৬৭৯ কোটি ৮৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি টয়লেটে খরচ ধরা হয়েছে ২২ হাজার টাকা করে।

প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই জমা দেয়া হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিকল্পনা সার্কেল) মোহাম্মদ আনোয়ার ইউসুফ বলেন, ‘এখন পরিকল্পনা কমিশন বলছে, ফিজিবিলিটি স্টাডি করে জমা দিতে হবে। তাই আমরা ফিজিবিলিটি স্টাডি করেই জমা দেব।’

পিডি/এইচএ/এমএস