মতামত

ব্যক্তি স্বাধীনতা বনাম নারী স্বাধীনতা

লেখার বিষয় হিসেবে আমার সবচেয়ে অপছন্দ হলো মেয়েদের পোশাক। আমার কাছে মনে হয় সম্পূর্ণ সময়ের অপচয়। তারপরও দুদিন পরপর এমন সব ঘটনা ঘটে যে চুপ করে বসে থাকতে পারি না। বাংলাদেশের এক মা বোরকা পরে ছেলের সাথে ক্রিকেট খেলেছে। এই বিষয় নিয়ে এমন শোরগোল কেন আমি তিন চার দিন ধরে চিন্তা করেও বের করতে পারছি না। একজন বাবা যদি খেলত মায়ের বদলে সেটা খুব স্বাভাবিক হতো, তাই না? যদি একজন মা শার্ট প্যান্ট পরে খেলত, তাহলেও মনে হয় ধরে নেওয়া হতো একজন অত্যাধুনিক মা খেলছে। সেখানে মাতৃত্বের অপরূপ রূপটাই সবাই দেখত। বাংলাদেশে মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে এ নিয়েও অনেকেই খুশি হতো। তো এই বোরকা পরা মা কী গুরুতর অপরাধ করে ফেলল যে মাতৃত্বের মতো মহান ব্যাপারটাও ম্লান হয়ে গেলো? এটা বোঝার জন্য অনেকের অনেক বিশ্লেষণও পড়লাম। আমি আবারো দেখলাম, আমাদের সমাজ আসলে তিন দলে বিভক্ত। যে কোন বিষয়ের সাথে ধর্মের সামান্য যোগসূত্র থাকলে, বিশেষ করে 'নারী' শব্দটি থাকলেই এই তিন দলের চেহারা বেড়িয়ে আসে।

Advertisement

অনেক অনেক দিন আগে আমরা একটা সুখী পরিবারের মতো দেশ ছিলাম। যেখানে এই ধর্মীয় ব্যাপারে দ্বিধা বিভক্তি ছিল না। ধর্মটাকে যে যার মতো বুঝে নিয়ে পালন করতো বা করতো না। এটা নিয়ে না ছিল জবরদস্তি, না ছিল বিদ্বেষ। কিন্ত আমাদের প্রিয় দেশ এখন তিনভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং ভীষণ মোটা দাগে বিভক্ত। এদের এক ভাগ এখনো প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে সেই সোনালি অতীত ধরে রাখতে। কিন্তু সংখ্যায় এবং ক্ষমতায় এরা সবচেয়ে দুর্বল এবং নিরীহ। এরা এখনো চিঁ চিঁ করে কোন রকমে বলছে, 'আহা কী মিষ্টি ছবি, মাতৃত্বের অপূর্ব রূপ। ছেলের সাধ মিটাতে মা হাতে তুলে নিয়েছে ব্যাট বল।' আশ্চর্যজনকভাবে সেই মাও কিন্তু তাই বলেছে। ছেলের শখ মিটাতে সে সব করতে পারে।

কিন্তু চুলকানি শুরু হলো নব্য গঠিত বাকি দুই দলের। এদেরকে অবশ্য এখন আর নব্য বলা যায় না। আর বয়সে নবীন হলেও পেশি শক্তিতে এরা দুজনাই বেশ শক্তিশালী। মধ্যপ্রাচ্যের মদদে পুষ্ট নতুন ধার্মিকরা ফতোয়া দেওয়া শুরু করলো 'মেয়েদের জন্য খেলাধুলা হারাম'। বোরকা পরা এক নারী কিভাবে এধরনের এক জঘন্য কাজ করলো। আর ধর্ম বিদ্বেষীদের অভিযোগ আরও অদ্ভুত। কেন এই মায়ের গায়ে বোরকা? বোরকা মানেই ধর্মীয় অনুশাসন। কোন না কোনভাবে তাকে জোর করে এই পোশাক পরানো হয়েছে। জোর না করলেও তাকে প্রভাবিত করা হয়েছে, ধর্মের আফিম গুলে খাওয়ানো হয়েছে। আমার মাথায় যেটা ঢুকে না সেটা হলো, কেউ ধার্মিক হলে তাকে জোর করে, প্রভাবিত করে সবকিছু করানো হয়, আর ধর্ম বিদ্বেষী হলে সে কারো প্রভাবে প্রভাবিত না এই যুক্তি কেমন যুক্তি?

আমরা আসলে কী চাই? আমরা চাই ব্যক্তি স্বাধীনতা। সেই ব্যক্তি নারী হোক বা পুরুষ। চাই তার বাক স্বাধীনতা, বিশ্বাসের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, পোশাকের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এই মা কিন্তু নিজ মুখে বলেছেন সে বোরকা পরে তার নিজের বিশ্বাস থেকে, সেই বিশ্বাসের কারনেই সে ছেলেকে কোরানে হাফেজ বানানোর স্বপ্ন দেখে। আবার নিজের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ এবং ছেলের শখের কারণে সে স্বপ্ন দেখে ছেলে বড় ক্রিকেট খেলোয়াড় হোক। সামাজিক অনুশাসনকে উপেক্ষা করে সে নিজের বিশ্বাস এবং স্বপ্নকে লালন পালন করছে, এটাই কি একজন আধুনিক নারীর তথা মানুষের রূপ হওয়ার কথা না? নাকি আমরা তার সেই স্বাধীনতাকে হরণ করতে চাই? তাকে জোর করতে চাই, খেলতে হলে বোরকা খুলতে হবে, তোমার বিশ্বাসকে বিসর্জন দিতে হবে? অথবা অপর পক্ষীয় জবরদস্তি তুমি নারী, তুমি বোরকা পরে ঘরে বসে থাকো। দুটোই কি এই নারী এবং তার সন্তানকে পেছনে টেনে নেবে না?

Advertisement

আমরা চাই বা না চাই যুগে যুগে মানুষের চিন্তায়, আচরণে, পোশাকে, আচারে পরিবর্তন আসবেই। আমরা মানুষ বলেই চিন্তাশীল, জড় পদার্থ তো নই। তাই আমাদের নারীদের পোশাকে শাড়ির পাশাপাশি যেমন সালওয়ার কামিজ, পশ্চিমা পোশাক এসেছে, সেই সাথে এসেছে মধ্য প্রাচ্যের বোরকা, হিজাব। ছেলেদের পোশাকে লুঙ্গির পাশাপাশি এসেছে প্যান্ট শার্ট, গেঞ্জি, পাজামা, পাঞ্জাবি। সংস্কৃতিতে মিশেছে হিন্দি, পশ্চিমা সংস্কৃতি। নতুন বিশ্বাস, আচার বা পোশাকের আগমনে সমস্যা নেই যতক্ষণ না সেগুলো দলীয়করণ বা মোটা দাগের বিভক্তি করে মানুষের মনে বিদ্বেষ ছড়ায়। আমাদের দেশ এমনিতেই পিছিয়ে আছে অনেক দিকে অনেক খানি। দেশের অর্ধেক জনসমাজকে নিয়ে এইসব অপ্রয়োজনীয় তর্ক না ফেঁদে তাদেরকে শুধু মানুষ হিসেবে ভাবলে অনেক সমস্যের সমাধান হয়। নারী স্বাধীনতা কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতারই আরেক রূপ।

এইচআর/জেআইএম