প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী
Advertisement
খিচুড়ি খাননি বা এর রন্ধন প্রক্রিয়া কমবেশি জানেন না এমন মানুষের সংখ্যা দেশে খুবই কম। খিচুড়ি আমাদের দেশের অত্যন্ত প্রিয় একটা খাবার। শহর গ্রাম সকল জায়গায় এর কদর প্রশ্নাতীত। বৃষ্টির দিন হলে তো কথাই নেই। খিচুড়ির সাথে ইলিশ মাছ ভাজি রসনা বিলাসীদের অতিপ্রিয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ডাইনিং এ সকালের নাস্তায় খিচুড়ির সাথে আলু ভর্তা খাননি এমন গ্রাজুয়েট খুঁজে পাওয়া বেশ ভার। সেই খিচুড়ি রান্না ও পরিবেশন শিখতে এবার বিদেশ যাবেন বেশকিছু কর্মকর্তা। দেশে এসে তারা নাকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুল ফিডিং কার্যক্রমকে আরও উন্নত, কার্যকরী ও গতিশীল করতে অবদান রাখবেন। এমন এক অদ্ভুত প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছেন। যা নিয়ে বর্তমানে দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্ট্রি হয়েছে। এমন এক প্রস্তাবনা চারিদিকে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মারফত জানা যায় যে সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে "মিড ডে মিল" প্রকল্পের আওতায় শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার হিসেবে স্বাস্থ্যসম্মত খিচুড়ি খাওয়ানো হবে। বর্তমানে দেশের ১৬টি উপজেলায় পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে প্রায় ১০০০ বিদ্যালয়ে সপ্তাহে তিন দিন দুপুরে রান্না করা খিচুড়ি শিক্ষার্থীদের খাওয়ানো হয়। চলমান প্রকল্পটি সারাদেশে চালু করতে ১৯হাজার ২৯০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরী করে তা অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ৫০০ কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠিয়ে খিচুড়ি রন্ধন ও পরিবেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবার কথা বলা হয়েছে। যা বিবেকবান প্রতিটি মানুষের মনে চরম নাড়া দিয়েছে। বিষয়টি এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে
এদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রাথমিকভাবে ৫০কর্মকর্তার বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রায় ৫ কোটি টাকা চেয়েছে। এছাড়া দেশেই প্রশিক্ষণের জন্য আরও ১০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত এই রান্না করা খাবার বিতরণ কর্মসূচির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯ হাজার ২৮৪কোটি টাকা। এর আওতায় পাঁচ বছর ধরে প্রায় ১কোটি ৪৮ লাখ শিক্ষার্থীকে পুষ্টিকর বিস্কুট ও রান্না করা খিচুড়ি পরিবেশন করা হবে। ৫০৯টি উপজেলার শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই খাবার পরিবেশন করা হবে। তবে পরিকল্পনা কমিশন এই প্রকল্পের নানাবিধ ব্যয় কমাতে বলেছে। বিদেশ সফরের জন্য দুটি দলে অল্পসংখ্যক কর্মকর্তাকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠাতে বলা হয়েছে। এছাড়া দেশেও এ ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণের এর বিষয়ে যৌক্তিকতা কি তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
Advertisement
সমালোচনার মুখে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আকরাম-আল-হোসেন জানিয়েছেন খিচুড়ি রান্নার প্রশিক্ষণের জন্য নয় অন্যান্য দেশ স্কুলে মিড ডে মিল দুপুরের খাবার কিভাবে বাস্তবায়ন করে সে ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জনে বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে মোট প্রকল্পের অতি অল্প অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এই অর্থ ব্যয় কোন অপচয় নয় বরং অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। এদেশে বহু বোর্ডিং স্কুল আছে। হেফজখানা আছে। এতিমখানা আছে। সেখানে তিন বেলা রান্না করে খাওয়ানো হয়। অত্যন্ত সুচারুরূপে এবং দক্ষতার সাথে দীর্ঘদিন থেকে তারা এই কার্যক্রম সম্পন্ন করে আসছে। দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ডাইনিং সমুহে তিন বেলা রান্না করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে খাবার পরিবেশন করা হয়। প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। দেশে প্রচুর পরিমাণ ছাত্র ছাত্র হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করে। সেখানেও রান্না করা হয়। পরিবেশনও করা হয়। প্রশিক্ষণের কোন প্রয়োজন হয় বলে আমার জানা নেই।
আমি নিজে আমার পূর্বতন বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালেয় সর্ববৃহৎ হলের প্রভোস্ট ছিলাম। প্রায় ৫০০ শতাধিক ছাত্রের জন্য ডাইনিং এ তিনবেলা রান্না হতো। ছাত্রদের মাঝে তা পরিবেশনও করা হতো। প্রায় প্রতিদিন সকালের নাস্তার মেনূতে থাকতো খিচুড়ি আর আলু ভর্তা। কৈ তাদের কারো জন্য তো কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়নি? আসলে প্রকল্পের টাকায় বিদেশ ভ্রমন সরকারি কর্মকর্তাদের ফ্যাশনে পরিণত হয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণকে নিরুৎসাহিত করার তাগিদ দিলেও প্রকল্পের টাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণকে রোধ করা যাচ্ছে না।
শুধু খিচুড়ি রান্না করতে অভিজ্ঞতা অর্জন নয় বরং এর আগেও আমরা দেখেছি, যে কোন সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই প্রকল্পের টাকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অভিজ্ঞতা অর্জন বা প্রশিক্ষণের নামে সরকারি কর্মকর্তারা দলবেঁধে বিদেশ ভ্রমণ করেন। কিছুদিন আগে পুকুর খননে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কিছু কর্মকর্তার বিদেশে যাওয়ার একটি খবর সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। নদীমাতৃক বাংলাদেশ পুকুর,নদী-নালা, খাল-বিলে ভরপুর। সেই দেশের মানুষ যখন পুকুর খননের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য দলবেঁধে সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণ করতে যান তখন লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। যে সব সরকারি কর্মকর্তা এমন সব আজগুবি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য পিকনিক ম্যুডে বিদেশে গিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করেন তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা উচিৎ। দেশে এমন কোন কর্মকর্তা কি আছেন যিনি পুকুর কি ভাবে খনন করেন তা জানেন না? মোটেই কিন্ত তা নয়।
Advertisement
করোনাকালে যখন দেশের সার্বিক অর্থনীতি অনেকটা স্ভবির। দেশের দীর্ঘমেয়াদী বন্যা, সুপার সাইক্লোন আম্ফানের প্রভাবে গ্রামীন অর্থনীতির চাকা বেশ মন্থর। বিদেশী বিনিয়োগ অপ্রতুল। চাকুরি হারিয়ে দিশেহারা বহুমানুষ। দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই অচল। বিদেশি শ্রমবাজার ঋণাত্নক। সরকারের ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরশীলতা যখন দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে খিচুড়ি রান্না, পুকুর খননের অভিজ্ঞতা অর্জনের মত জন্য বিদেশে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ জনগণের ট্যাক্সের টাকার অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।
করোনাকালে যারা অপ্রয়োজনে প্রকল্পের টাকায় অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ যাওয়া প্রাধান্যদিয়ে প্রস্তাবনা প্রণয়ন করতে পারেন তাদের দেশপ্রেম, রুচিবোধ ও বিবেকবোধ নিয়ে প্রশ্নতোলাই যায়। খিচুড়ি রান্নার অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ ভ্রমণ করার পরিকল্পনার যেসব হর্তাকর্তা জড়িত তাদের বিবেকবোধ বলে কি আর কিছুই অবশিষ্ট নেই? মহামারি করোনাকালে এমন অদ্ভুত প্রস্তাবনা মানুষের বিবেককে কঠিনভাবে নাড়া দিয়েছে। খিচুড়ি বাংলাদেশের মানুষের অত্যন্ত প্রিয় এবং সুস্বাদু একটি খাবার। এটি রান্না করার জন্য তেমন বিশেষ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা অর্জন করার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করার কোন কারণ নেই। খিচুড়ি রান্না করার রেসিপি নিয়ে তো ৮০'র দশকে নির্মিত বাংলা সিনেমার একটি বিখ্যাত গান মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরতো।
নাই যে সমস্ত কর্মকর্তারা বিদেশে যাবেন বলছেন তারা নিশ্চয়ই কোন না কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কোন না কোন কলেজের শিক্ষার্থী। অতএব এই খিচুড়ি কিভাবে রান্না করা হয় বা কিভাবে তা বন্টন করা হয় সেটি তাদের অজানা নয়। কিন্তু শুধু সরকারি টাকা অপচয় করার জন্য বা নয়ছয় করার জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ ভ্রমণ বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন সরকার করোনাকালীন আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যায় নিপতীত গ্রামীণ অর্থনৈতি মন্দাকালীন সময় পার করছে।
চাকরি হারিয়ে দিশাহারা নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষ। শিল্প-কারখানায় উৎপাদনের গতি মন্থর। রেমিটেন্সের চাকা ততটা সচল নয়। বিদেশে কর্মসংস্থান ধীরে ধীরে কমে আসছে। এমন একটি জটিল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ ধরনের বিলাসী প্রস্তাবনা যারা প্রস্তত করতে পারে তাদের শুধু ধিক্কার নয় চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনাটা জরুরি। একাজে জড়িতদের বিবেকবোধ এবং জাতির প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা আজকে চরমভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। তবে দেশে শুধু এই খিচুড়ি অভিজ্ঞতা অর্জনই নয় এরকম বহু অপ্রয়োজনীয় কাজে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। করোনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুকেই স্থবির করেছে সত্য কিন্তু স্থবির করতে পারেনি দুর্নীতিকে, স্থবির করতে পারেনি সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণের নেশাকে।
লেখক : আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।drhasnat77@gmail@gmail.com
এইচআর/জেআইএম